মহসিন কবির: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সময় নিয়ে কথা বললেন। তিনি বলেছেন, মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।
প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেই নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ দেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, নির্বাচনী রোডম্যাপ খুব স্পষ্ট দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত তারিখ কী? সেটা নির্ভর করবে সংস্কারের ওপর। তিনি একটা সময় দিয়ে দিয়েছেন। এর চেয়ে পরিষ্কার রোডম্যাপ কী হতে পারে? আপনি আশা করতে পারেন ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এখন আপনি যদি বলেন মনোনয়ন দাখিলের সময় কবে? সেটা নির্বাচন কমিশন দেবে।
এ ঘোষণার পরই থেকেই রাজনীতিবিদরা নানা মন্তব্য করেছেন। রাজনৈতিক নেতারা জাতীয় নির্বাচন ঘোষণার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চান। তারা বলছেন রাজনৈতিক নেতাই মূল সংস্কার করবেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা রোডম্যাপ দেবেন। কিন্তু তিনি তা দেননি। এটা আমাদের হতাশ করেছে। বৃহস্পতিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো প্রস্তুতি দেখছি না। নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ ও তাঁর প্রেস সচিবের বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক বলেও উল্লেখ করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘তাঁদের দেওয়া বক্তব্য কোনটা সঠিক, আমরা বুঝতে পারছি না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ পগণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়েছেন মাত্র। কিন্তু তাতে সুস্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ নেই। প্রয়োজনীয় কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার করা হবে, সে জন্য কতটা সময় প্রয়োজন, তা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে স্পষ্ট নয়। আমরা আশা করি, তিনি সংস্কারের সময় ও নির্বাচনের সময় সুনির্দিষ্ট করে একটি রোডম্যাপ দেবেন।
সরকার যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এসব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার শেষে দ্রুত সময়ে নির্বাচন চায় জামায়াতে ইসলামী। দলটির মতে, নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ সময় দেওয়াও ঠিক হবে না। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা বারবার বলে আসছি, সংস্কার দ্রুত সময়ে শেষ করে দ্রুত এবং যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দিতে হবে। আবার নির্বাচনের জন্য দীর্ঘ সময় দেয়াও ঠিক হবে না। কেউ পাঁচ-ছয় বছর থাকলে তাদের ক্ষমতার জন্য লোভও হয়ে যেতে পারে। সেটা আমরা অতীত থেকে ধারণা পেয়েছি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের পথে নেই বলে মনে করছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। নির্বাচন প্রসঙ্গে স্পষ্ট কোনো কথা না বলায় এ নিয়ে আরো বেশি শঙ্কা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা নির্বাচনের পথে আছি। সমাজের সব অংশীজন নিয়ে নির্বাচন হোক, সেটা চাই। যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন হওয়া দরকার। আমরা চাইব অনির্বাচিত সরকার যেন নিরেপক্ষ থাকার দায়িত্বে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকে।
ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, যেনতেনভাবে নির্বাচন চান না তারা। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ২০২৫ সালের শেষ কিংবা ২০২৬ সালের প্রধমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছেন। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সময় লাগলেও তাতে আমাদের আপত্তি নেই। ২০২৬ সালেও নির্বাচন হতে পারে।
সরকার আন্তরিক হলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা সম্ভব বলে মনে করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নিতে কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে কোনো বাধা-বিপত্তি দেওয়া হবে না।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) দুপুরে রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে মুক্ত আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘অতীতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ায় নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে নির্বাচনী কর্মকর্তারা সব ধরনের প্রভাবমুক্ত থাকবেন। যে কারণে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে।’
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় উপদেষ্টারা নির্বাচনের তারিখ নিয়ে বিভিন্ন রকম মন্তব্য করে জাতিকে বিভ্রান্ত করছেন। তাদের কাজ হলো নিজস্ব মন্ত্রণালয় সম্পর্কে বক্তব্য রাখা, নিজস্ব মন্ত্রণালয় নিয়ে ব্যস্ত থাকা। কিন্তু সেটা না করে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করছেন, সেটা ঠিক নয়। আমরা আশা করব, প্রধান উপদেষ্টা একটা রোডম্যাপ দেবেন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারের দক্ষতা যোগ্যতা যদি থাকে, সরকারের কাজে যদি গতি আনা যায়, তাহলে মনে করি, নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সংস্কার করে আগামী বছরের মধ্যেই এই নির্বাচন করা সম্ভব, যেটা ইঙ্গিত (ড. ইউনূস) দিয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :