মানবজমিন’র প্রতিবেদন।। ভাঙা ঘরে যেন চাঁদের আলো ঝলমল করছে। সেই আলোয় আলোকিত পুরো পরিবার। এতে গর্বের অন্ত নেই গ্রামবাসীরও। সেই আলোকিত নক্ষত্রের নাম নন্দিনী রানী সরকার। এবার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়ে মেধাতালিকায় উঠে এসেছে তার নাম। এমনকি নন্দিনীর মেডিকেল কলেজ জয়ের খবর শুনে সুদূর লন্ডন থেকে তার জন্য উপহার সামগ্রি পাঠিয়েছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জেলা বিএনপি’র সভাপতি আফরোজা খান রিতাসহ কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতৃবৃন্দ শুক্রবার সন্ধ্যায় তারেক রহমানের পাঠানো মেডিকেলের প্রথমবর্ষের বই ও ভর্তির টাকা নন্দিনীর হাতে তুলে দেয়ায় দরিদ্র পরিবারের এই মেধাবীর পড়াশোনায় উৎসাহ আরও বেড়ে গেছে।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গিলন্ড এলাকার হতদরিদ্র অটোরিকশাচালক অনিল চন্দ্র সরকারের মেয়ে নন্দিনী। সামান্য অটোরিকশা চালিয়ে দুই মেয়ের লেখাপড়া আর সংসারের খরচ যোগান দিতে রীতিমতো তাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তারপরও হাল ছাড়েনি। দারিদ্র্যের কষাখাতে জর্জরিত হয়েও এই গর্বিত পিতার স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। কানিজ ফাতেমা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী নন্দিনী পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ এবং এসএসসি ও এইচএসসি’র দুই পরীক্ষাতেই সমানতালে জিপিএ-৫ পাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে। বাবার স্বপ্নের সঙ্গে নন্দিনী নিজেও স্বপ্ন দেখতেন চিকিৎসক হওয়ার। এইচএসসি পাস করার পরপরই চিকিৎসক হওয়ার হাতছানি তাকে তাড়া করে বেড়ায়। অভাব-অনটনের সংসারে নন্দিনী মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে। দিন- রাত বইয়ের সঙ্গেই চলে তার সখ্য। পরীক্ষার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর ১৭ই জানুয়ারি এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধে নাম লেখান। একদিন পর ১৯শে জানুয়ারি ফলাফল ঘোষণায় দেখা যায়, মেধাতালিকায় নন্দিনী রানী সরকারের অবস্থান ১৩৩। একই সঙ্গে নন্দিনীর আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন যেন হাতের মুঠোয় চলে আসে। আনন্দের পাশাপাশি ছিল এক ধরনের শঙ্কাও। মেডিকেলে ভর্তি ও পড়াশোনার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায়ও দিন কাটতে থাকে হতদরিদ্র পরিবারটির। তবে চারদিক থেকেই নন্দিনীর পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন অনেকেই।
শুক্রবার দুপুরে সরজমিন নন্দিনীর বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি টিনের ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে শুধু বই আর বই। কাঠের চৌকিতে বসে পড়াশোনা করতে দেখা যায় নন্দিনীকে। আর বাহিরে জনাকীর্ণ চারপাশ খোলা রান্নাঘরে নন্দিনীর মা শিমা সরকার রান্নায় ব্যস্ত। বাবা অটোরিকশা চালিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া নিয়ে কথা হয় নন্দিনী ও মা-বাবা এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে। মেয়ের সফলতায় পরিবারের সবাই আনন্দিত। দুপুরের পরপর নন্দিনীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন যে কলেজ থেকে লেখাপড়া করে কৃতিত্ব অর্জন করেছে সেই কানিজ ফাতেমা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আবদুল হালিম এবং আরেক শিক্ষক। এরপর বিকালে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পাঠানো উপহার সামগ্রী নিয়ে নন্দিনীর বাসায় আসেন বিএনপি’র চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপি’র সভাপতি আফরোজা খান রিতা ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সভাপতি তৌহিদুর রহমান আউয়ালসহ একঝাঁক বিএনপি নেতৃবৃন্দ। এ সময় আফরোজা খান রিতা নন্দিনীকে বুকে জড়িয়ে আদর করেন।
মানবজমিন’র কাছে নন্দিনী তার মেডিকেল জয়ের সফলতার গল্প তুলে ধরেন। বলেন, আমার বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে। তাদের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য ভালোভাবে পড়াশোনা শুরু করি। কানিজ ফাতেমা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে আমি এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছি। আমার বাবা হতদরিদ্র অটোরিকশাচালক হওয়ায় আমার এবং ছোট বোনের লেখাপড়ার খরচ চালাতে তার খুব কষ্ট হয়। যার কারণে আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে বই-খাতা কলমসহ সব ধরনের সহযোগিতা এবং স্যারেরা সবসময় আমার এবং বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণে পাশে থেকে এবং উৎসাহ দিতেন। এসএসসি পাস করার পর কানিজ ফাতেমা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ঢাকায় কোচিং করার সময় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। মেডিকেলে পরীক্ষা দেয়ার পর আমার রেজাল্ট দেখে পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবাই খুশি। বাবা- মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পেরে আমি খুশি।
কেমন চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা- এ প্রসঙ্গে নন্দিনী বলেন, একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব রোগীর সঠিক সেবা দেয়া। আমি যেহেতু দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছি সেহেতু আমি চাই টাকার কারণে বিনা চিকিৎসায় কোনো রোগী যেন মারা না যায়। আমার ইচ্ছা দরিদ্র রোগীদের সঠিক চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেয়া। একজন মানবিক চিকিৎসক হয়ে যাতে মানুষের সেবা করতে পারি- এটাই আমার অঙ্গীকার।
নন্দিনী আরও বলেন, মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার খবর পেয়ে সুদূর লন্ডন থেকে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের মানিকগঞ্জের মানবতার ফেরিওয়ালা আফরোজা খান রিতা আপা এবং ছাত্রদলের মাধ্যমে মেডিকেলের বইসহ উপহার সামগ্রী পাঠানোর জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তার এই মহানুভবতার কারণে আমার উৎসাহ আরও বেড়ে গেল।
নন্দিনীর মা বলেন, একজন মা হিসেবে আমি চাই আমার মেয়ে একজন প্রকৃত চিকিৎসক হবে। যেখানে কোনো অহঙ্কার থাকবে না বিশেষ করে গরিব মানুষ যেন তার কাছ থেকে কখনোই বিমুখ হয়ে না ফেরেন।
‘তারেক রহমানের পাঠানো উপহার নিয়ে রিতা’
হতদরিদ্র ঘরের সন্তান নন্দিনী রানী সরকার মেডিকেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাওয়ার খবরে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে নন্দিনীর জন্য উপহার সামগ্রী পাঠিয়েছেন। শুক্রবার বিকালে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের একটি টিম মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপি’র সভাপতি আফরোজা খান রিতাকে নিয়ে নন্দিনীর বাড়িতে হাজির হন। এ সময় নন্দিনীকে বুকে জড়িয়ে নেন আফরোজা খান রিতা। প্রথমে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর পর তারেক রহমানের পাঠানো মেডিকেলে প্রথম বর্ষের বই ও ভর্তির টাকা নন্দিনীর হাতে তুলে দেন। রিতা নিজের হাতে নন্দিনীকে মিষ্টিমুখ করান। নন্দিনীর পড়াশোনার দেখভালের দায়িত্ব বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়েছেন বলে নন্দিনী ও তার পরিবারকে আশ্বস্ত করেন আফরোজা খান রিতা। রিতা নিজেও নন্দিনীর পড়াশোনার জন্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
এ সময় আফরোজা খান রিতা বলেন, নন্দিনী হচ্ছে আমাদের মানিকগঞ্জের অহঙ্কার। তার এই সফলতায় আমরা গর্বিত। সুদূর লন্ডন থেকেও নন্দিনীর সফলতার বিষয়টি আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নজরে এসেছে। তার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সভাপতি তৌহিদুর রহমান আউয়াল, জেলা ড্যাব’র সভাপতি ডাক্তার বদরুল আলম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার জিয়াউর রহমান জিয়া, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল খালেক শুভসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
আপনার মতামত লিখুন :