আশরাফুল, জাবি: [২] কোটা আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক এ কর্মসিূচিতে অংশ নেন।
[৩] বুধবার (৩১ জুলাই) দুপুর একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদ ভবন সংলগ্ন মহুয়া মঞ্চের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার সংলগ্ন সড়ক, নতুন প্রশাসনিক ভবন প্রদক্ষিণ করে একই স্থানে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ করেন তারা।
[৪] এরপর একই স্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী লিয়নসহ গ্রেফতারকৃত সকল শিক্ষার্থীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা স্বাক্ষর করেন।
[৫] সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, 'সরকার একটি মিথ্যার উপর দাড়িঁয়ে আছে। এই দেশে এখন কোন গনতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা আছে- এটি মনে করার কোন কারণ অবশিষ্ট নেই। সরকার আজ পর্যন্ত এত নির্মমতা, এতো হত্যাকান্ড, এতো নির্যাতন, এতো নিপীড়নের পরেও কোন প্রকার দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেনি। অথচ আমরা স্পষ্টভাবে দেখেছি এই সহিংসতা ছড়ানোর পেছনে একজন মন্ত্রীর কী পরিমান দায়দায়িত্ব রয়েছে। তিনি একটি বিশেষ ছাত্রসংগঠনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তার পরেই কিন্ত সংর্ঘষ ছড়িয়েছে।'
[৬] তিনি আরো বলেন, 'এই আন্দোলন এখন আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নেই। এটি শিক্ষক-শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন হয়ে গেছে। একটি রাষ্ট্র যখন সংকটে পতিত হয়, একটি রাষ্ট্রের যখন আমূল পরিবর্তনের দরকার হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সৃষ্টিই হয়েছে রাষ্ট্রকে পথ দেখানোর জন্য। রাষ্ট্রের যে ডেমেইজ তার পূর্ণনির্মাণ করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। সরকারকে বলতে চাই আপনারা যে ভয়ের সংস্কৃতি দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন সেটিতে আপনারা ব্যর্থ হয়েছেন। আপনারা সত্য স্বীকার করতে শিখুন, ভূল স্বীকার করতে শিখুন। প্রত্যেকটি হত্যাকান্ডের সুষ্টু তদন্তের মাধ্যমে বিচার করুন।'
[৭] নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেন, 'সরকার আশা করছিলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তর হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট থেকে যখন রায় হবে হল যখন বন্ধ থাকবে ততক্ষণে সবকিছু শান্ত করে ফেলা যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে তার মধ্যে পুরো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কতগুলো উস্কানি দেয়ার কারণে। নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুতে বাংলাদেশের এমন কোন বর্গ নাই যেখানে একান্তে মানুষ হাহাকার না করছেন। কান পাতলেই সরকার ও সরকারপন্থী গায়েনরা এসমস্ত কথা শুনতে পারতো। মানুষজন কিভাবে শোক করছে।'
[৮] তিনি আরো বলেন, 'এই মূহুর্তে যে ধরণের ধরপাকড় চলছে সেই মডেলটি খুবই পরিচিত। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে এমন ধরপাকড়ের ইতিহাস নাই। বাংলাদেশের জেলায় জেলায়, মহকুমায় মহকুমায়, থানায় থানায় এমনকি শিক্ষার্থী না সাধারণ শ্রমিকদের টার্গেট করে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। সরকার যেমন গোয়ার্তুমি করে নো রিটার্নে গেছে আমাদেরও হকের জন্য, ন্যায় বিচারের জন্য, স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য পয়েন্ট অব নো রিটার্নে যেতে হবে।'
[৯] বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিহা বলেন, 'যারা আজকে আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি করছে, যারা জনগনের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বেঁচে খেতে চায়। আমরা বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো একক দলের চেতনা নয়। স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সাম্যের চেতনা সারা বাংলার মানুষের চেতনা। অতএব দিনের পর দিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে মানুষের উপর স্বৈরশাসন চালাবেন, দুঃশাসন চালাবেন, গুলি চালাবেন, তাহলে জনগণ আপনাকে রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্মের নাম করে তারা জনগনের বিপক্ষে দাড়িয়েছিলো। আর এখন আপনারা স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে জনগনের বিপক্ষে দাড়িয়েছেন।'
[১০] তিনি আরো বলেন, 'আন্দোলনকে দমন করার জন্য শাসকগোষ্ঠী প্রতিদিন নতুন নতুন কাহিনী তৈরি করে। শুনেছি, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নাকি নিষিদ্ধ করতে চায় সরকার। তাদেরকে নিষিদ্ধ করার দাবি তো আরও অনেক আগেই উঠেছিলো। জাহানারা ইমাম যখন রাজাকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে সেই আন্দোলনে সাধারণ জনতার দাবি ছিলো জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। কিন্তু সেই জামায়াত-শিবিরকে সাথে নিয়েই একসাথে হরতাল পালন করলেন, একসাথেই কর্মসূচি পালন করলেন, ধরপাকড় করলেন, মানুষকে মারলেন, গাড়ি পোড়ালেন, তখন তো আপনি জামায়াত'শিবিরের রাজনীতিকে নিষদ্ধের দাবি তোলেন নাই। এই সময় কেন আপনি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চাচ্ছেন? আমাদের কাছে এটি বড় প্রশ্ন হিসেবে হাজির হচ্ছে। আপনি কি আন্দোলনকে থামানোর জন্য আরও একটি কৌশল ব্যবহার করছেন কিনা সেটি আমাদের কাছে সন্দেহের উদ্রেক করছে।'
[১১] সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াজুল ইসলাম রিহানের সঞ্চালনায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শামীম হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার সমন্বয়ক আব্দুর রশিদ জিতু ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী অমর্ত্য রায় প্রমুখ। সম্পাদনা: এ আর শাকিল
প্রতিনিধি/এআরএস
আপনার মতামত লিখুন :