সুজন কৈরী: [২] সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে মঙ্গলবার রাজধানীর সাইন্সল্যাব মোড়, শান্তিনগর-বেইলি রোড, ফার্মগেট, গাবতলী-মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, নতুন বাজার, মধ্যবাড্ডা, নদ্দা, কুড়িল বিশ্বরোড, মহাখালী-বনানী, রায়সাহেব বাজার, মতিঝিল শাপলা চত্বর, শহীদমিনারসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলন করেন।
[৩] আন্দোলন চলাকালে মঙ্গলবার বিকলে ৫টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিভিন্নস্থানে সংঘর্ষে একজন নিহত ও সাতজন গুলিতে আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
[৪] মঙ্গলবার সকাল থেকে ছোট ছোট দলে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়কগুলোতে অবস্থান নেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারসহ কোটা সংস্কারের দাবিতে নানা স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা। রাস্তা অবরোধের কারণে সড়কগুলোতে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। ভোগান্তিতে পড়েন হাজার হাজার যাত্রী।
[৫] মঙ্গলবার ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে পেট্রোল পাম্পের সামনে থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় ওই যুবককে উদ্ধার করে একজন পথচারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে নিহতের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
[৬] ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, নিহত যুবকের কানের নিচে ও মুখের বিভিন্ন জায়গায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
[৭] নিহত যুবককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া পথচারী আকাশ মামুদ বলেন, গুরুতর আহত অবস্থায় এক যুবককে ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে পেট্রোল পাম্পের সামনে পড়ে থাকতে দেখি। পরে তাকে হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসক জানান তিনি আর বেঁচে নেই। প্রাথমিকভাবে আমরা ওই যুবকের নাম পরিচয় জানতে পারেনি। তার ঘাড়ে ও মুখের বিভিন্ন জায়গায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
[৮] মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর চানখারপুল এলাকায় গুলিতে আহত হয়েছেন আন্দোলনরত দুইজন। এ সময় ছাড়া ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় প্রায় ২০ জনেরও বেশি আন্দোলনকারী আহত হয়েছেন।
[৯] এর আগে বেলা ৩টার পর থেকে দ্বিতীয় দিনের মতো কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় শহীদুল্লাহ্ হল থেকে চানখারপুল রোড রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে চানখারপুল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) এলাকা দখলে নেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
[১০] মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে রাজধানীর তাঁতিবাজারে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) দুই শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তারা হলেন- ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী অনিক (২২) ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নাসিম (২২)। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়।
[১১] ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) বাচ্চু মিয়া বলেন, তাঁতিবাজার এলাকায় ছাত্রলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের পেটে ও বুকে ছররা গুলি লেগেছে।
[১২] এছাড়া সকাল থেকে আহত আরও প্রায় ৪০ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার কথাও জানান তিনি।
[১৩] মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর মহাখালী পুলিশ বক্সের সামনে দুটি মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
[১৪] ডিএমপির ট্রাফিক-গুলশান বিভাগের এডিসি এ এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, মোটরসাইকেল দুটি পুলিশের কিনা তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
[১৫] মঙ্গলবার সাইন্সল্যাব মোড়ে ঢাকা কলেজ ও সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা, গাবতলী-মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব), নতুন বাজার/সাতারকুল এলাকায় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ), মধ্যবাড্ডায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, নদ্দা/বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেটে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, কুড়িল বিশ্বরোডে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি), মিরপুর ১০ নম্বর মোড়ে বিইউবিটি ও মিরপুর বাঙলা কলেজ, মহাখালী-বনানী সড়কে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরায় সাধারণ শিক্ষার্থী, তাঁতীবাজার এলাকায় সাধারণ শিক্ষার্থী, বেইলিরোড মোড়ে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং বাসাবো বৌদ্ধ মন্দির এলাকায় আন্দোলনকারীরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
[১৬] বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে রাজধানীর নতুন বাজার এলাকায় কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ঘটেছে।
[১৭] ডিএমপির বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার রাজন কুমার সাহা বলেন, বেলা সাড়ে ১১টা থেকে নতুন বাজারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) শিক্ষার্থীরা অবরোধ শুরু করেন। এরপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে।
[১৮] কোটা বাতিল এবং হামলার প্রতিবাদে বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর বেড়িবাঁধ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাবের শিক্ষার্থীরা। ফলে রাজধানীর গাবতলী থেকে মোহাম্মদপুর হয়ে ধানমন্ডি সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
[১৯] বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিউবিটির (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি) ও বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থীরা বেলা ১২টার পর রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। রাস্তা অবরোধের ফলে মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বর ঘিরে থাকা সবগুলো সড়কে বড় ধরনের যানজটের সৃষ্টি হয়। বিকল্প সড়ক ব্যবহার করে অনেক যানবাহন।
[২০] কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ক্লাস-পরীক্ষাসহ সব ধরনের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করেছেন রাজধানীর নীলক্ষেতের গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্সের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার সকাল থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনো ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেননি। একইসঙ্গে তাদেরকে ‘বয়কট এক্সাম, বয়কট ক্লাস’ প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
[২১] শিক্ষার্থীরা বলেন, সারা দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির বিরুদ্ধে একটি বিশেষ শ্রেণি পরিকল্পিতভাবে দাঁড়িয়েছে। তারা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের মেধাবী শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। যার প্রতিবাদে আমরা সব ধরনের ক্লাস-পরীক্ষাসহ অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত না কোটা বাতিল করা হবে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের বিচার করা হবে ততক্ষণ এ বর্জন কর্মসূচি চলবে।
[২২] দুপুর সাড়ে ১২টার পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে মতিঝিলে শাপলা চত্বর মোড়ে অবস্থান নেয় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে অচল হয়ে পড়েছে ব্যাংকপাড়া হিসেবে খ্যাত মতিঝিল এলাকা। শিক্ষার্থীরা ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’সহ কোটা সংস্কারের দাবিতে নানা স্লোগান দিতে থাকেন।
[২৩] রাজধানীর সায়েন্স-ল্যাবরেটরি মোড়ে ছাত্রলীগ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া এবং মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। বেলা সাড়ে ৩টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলছিল। সেখানে ৩টি ককটেল বিস্ফোরণও ঘটেছে।
[২৪] ধানমন্ডি ল্যাবএইড হাসপাতাল থেকে শুরু করে সাইন্সল্যাবরেটরি মোড় পর্যন্ত কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সমর্থন জানিয়ে আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, ঢাকা কলেজ এবং মুন্সী আব্দুর রউফ কলেজ এর উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শতাধিক শিক্ষার্থী রাস্তা অবরোধ করে অবস্থান নিয়েছেন। বিপরীত পাশে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ, স্থানীয় ব্যবসায়ী, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছেন। থেমে থেমে তাদের মধ্যে চলছে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং ইট পাটকেল নিক্ষেপ। ইটের আঘাতে উভয় পক্ষেরই বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
[২৫] কোটা সংস্কারের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও গুলিও ছুঁড়েছে। এতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী ফেরদৌস, ১৭ ব্যাচের অন্তু ও অনিকসহ চারজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
[২৬] মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনকারীরা লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে রায়সাহেব বাজার অতিক্রম করার সময় এ ঘটনা ঘটে।
[২৭] মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে রাজধানীর মহাখালী রেলগেটে রেললাইন অবরোধ করেছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এতে রেললাইনের দুপাশে দুটি ট্রেন আটকে থাকতে দেখা গেছে। বেলা ২টার দিকে রেলগেটের দুই পাশে দুটি ট্রেন আটকে থাকতে দেখা গেছে।
[২৮] একটি ট্রেনের চালক ওয়ারেস আলী বলেন, বনলতা নামের এই ট্রেনটির গন্তব্য রাজশাহী। বেলা ১ টা ৫০ মিনিটে ট্রেনটি মহাখালী রেলগেটে এসে আটকে আছে। সম্পাদনা: সমর চক্রবর্তী
আপনার মতামত লিখুন :