বিশ্বজিৎ দত্ত: জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ সালের বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ২০২১ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত্তির উপর স্মার্ট বাংলাদেশ পড়ার প্রত্যয় এই প্রস্তাবিত বাজেট। যা প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাপ্রসূত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি। অর্থমন্ত্রী বাজেটের শিরোনাম দিয়েছেন, উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে। তিনি এ নিয়ে একটি কবিতাও রচনা করেছেন। যার শেষ লাইনে বলা হয়েছে, উন্নয়নের নেই কোন শেষ, ২০৪১ এর মধ্যে হবে স্মার্ট উন্নত সোনার বাংলাদেশ।
স্মার্ট বাংলাদেশের প্রথম ধাপ হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করছেন অর্থমন্ত্রী। এটি জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চপ্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা নিয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে এবারের বাজেটে। আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬ শতাংশ।
বেলা ৩টার ৫ মিনিট পর স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশন শুরু হয়। অর্থমন্ত্রী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন শুরুর আগে একটি প্রামাণ্য চিত্র উপস্থাপন করা হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হয় এতে। এরপর বাজেট উপস্থাপন শুরু হয়। বাজেট অধিবেশনে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, চিফ হুইপসহ বিরোধী দলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে বেলা ১২টায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নতুন বাজেট অনুমোদন করা হয়। সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে অনুষ্ঠিত বিশেষ এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে বাজেট অনুমোদনের পরে সংসদ ভবনের রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে অপেক্ষমাণ রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নতুন বাজেট সংসদে উপস্থাপনের জন্য সম্মতিসূচক সাক্ষর করেন। এই দিন রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনের পরিবর্তে সংসদ ভবনের কার্যালয়ে অফিস করেন। নতুন বাজেটে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে সঙ্গে নিয়ে সংসদ অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তাদের স্বাগত জানান। অর্থমন্ত্রী সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি এবং কালো মুজিব কোট পরে সংসদে আসেন। হাতে ছিল লাল ব্রিফকেস। এই ব্রিফকেসে করেই বাজেট বই বহন করেন তিনি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এটি চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। বাজেটের এই ব্যয় মেটাতে মোট আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রা ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ৬৭ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা বেশি। নতুন বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে সরকারের মোট ব্যয় মেটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড়াও প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রণীত নতুন বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। বাজেটে মূল্যস্ফীতি বিচেনায় ব্যাক্তি শ্রেণীর করাদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা তুলনায় ৫০ হাজার টাকা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। মহিলাদের আয়ের সীমা বৃদ্ধি করে ৪ লাখ টাকা করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী করদাতাদের করসীমা ২৫ হাজার , যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও তৃতীয় লিঙ্গ করদাতার করসীমা ২৫ হাজার করে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ ছাড়া কর হারে কোন পরিবর্তন করা হয়নি। এর বাইরে সরকারি ৩৮টি সেবার নেওয়ার ক্ষেত্রে যে কোন ব্যাক্তির আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করে ২ হাজার টাকা করারোপ করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বসবাসকারীর ন্যূনতম কর আগের মতোই ৫ হাজার টাকা রাখা হয়েছে। কোম্পানির করের ক্ষেত্রে বড় কোন পরিবর্তন করা হয়নি। তবে ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে লেনদেনে আড়াই শতাংশ কর কম করা হয়েছে। ধনীদের সম্পদের উপর সারচার্জে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়েছে। আগে ৩ কোটি টাকার উপরে সম্পদ থাকলেই কর দিতে হতো এখন এটি ৪ কোটি টাকা করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে এসআরওর মাধ্যমে কর ছাড়কে নিরুৎসাহিত করতে সরকারি বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে যে কর ছাড় দেওয়া হয় তার জন্য একটি নতুন ফান্ড গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন কর ছাড়ের বিষয়টিকে সরকারের ভর্তুকি হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই ভর্তুকির পরিমাণ ২ লাখ ৮৯ হাজার ২২৮ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে আগের আয়কর অধ্যাদেশ পরিবর্তন করে নতুন আয়কর আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই আয়কর আইনটি করা হয়েছে সম্পূর্ণ বাংলায়। মূল্য সংযোজন করে মৌলিক কোন পরিবর্তন করা হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে সংশোধন করা হয়ছে। আমদানির ক্ষেত্রে আগের ৬ স্তর বিশিষ্ট শুল্ক হার বহাল রাখা হয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক হার আগের মতোই রাখা হয়েছে।
বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। ঋণ ও অগ্রিম পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বিশেষ প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা।
কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচি বাস্তবায়নে নতুন বছরের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। খাদ্য আমদানি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫০২ কোটি টাকা। এডিপির বাইরে বিভিন্ন স্কিম বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। সরকারের মূলধনী ব্যয় বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৯ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এছাড়া সরকারের অন্যান্য ব্যয় নির্বাহে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশের ঘরে রাখা হয়েছে। টাকার অঙ্কে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ (অনুদানসহ) ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বিদেশি ঋণ বাবদ পাওয়া যাবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সরকার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন খাত থেকে ঋণ নেবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থাপনা থেকে নেবে ১ লাখ ২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে নেবে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে নেবে ৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা বেশি বৈদেশিক ঋণ আগামী অর্থবছরে নেওয়া হবে। আর ঋণগ্রস্ত বেশি হওয়ায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বেশি টাকা গুনতে হবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে। এছাড়া বাড়ছে সরকারের মূলধনী ব্যয়ও।
প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের বেতন ভাতায়, এখানে মোট বাজেটের ২২ শতাংশ ব্যয় হবে। এরপরে রয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত এখানে ব্যয় হবে ১৩.৭ শতাংশ অর্থ। এর পরেই রয়েছে সুদ পরিশোধ সেখানে ব্যয় হবে ১২.৪ শতাংশ টাকা। স্বাস্থ্যে ব্যয় হবে ৫ শতাংশ ও কৃষিতে ব্যয় হবে বাজেটের ৫. ৭ শতাংশ অর্থ। সম্পাদনা: সালেহ্ বিপ্লব
বিডি/এসবি/এসবি২
আপনার মতামত লিখুন :