ঝুঁকির মুখে থাকা দেশের ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে ১০ দফা সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, এসব চ্যালেঞ্জ ভবিষ্যতের জন্য খাতটিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। তাই এই ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে সংস্থাটি ১০টি সুপারিশ করে।
গত বুধবার রাতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে যে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো হলো ব্যাংক খাতের নীতি কাঠামো উন্নত করতে অগ্রাধিকার প্রদান; আমানত সুরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করা; প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নতি; রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক পুনর্গঠন; খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি; সমন্বিত দেউলিয়া আইন প্রণয়ন; ব্যাংকিং আইন ও নীতির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা; জরুরি প্রয়োজনে তারল্য সহায়তা প্রদানের জন্য একটি নীতি কাঠামো তৈরি; ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চাগুলোর অনুশীলন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
বিশ্বব্যাংক বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত উচ্চ খেলাপি ঋণের চাপে রয়েছে। এ ছাড়া মূলধন স্বল্পতা, পরিচালন অদক্ষতা, সুশাসনের ঘাটতি, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করা, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং সুবিধাভোগীদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদানের গড়ে ওঠা ব্যবস্থা বছরের পর বছর ব্যাংক খাতের সক্ষমতাকে নষ্ট করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এই খাতের দুর্বলতাগুলো আমলে নিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে এ খাতের দুর্বলতাগুলো একে একে প্রকাশ হতে শুরু করেছে।
আইনি ফাঁকফোকরের মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্ককে ব্যবহার করে নানা ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে জোরালো ও শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, ব্যাংক খাতের সংকটের বড় ধরনের অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। এ ধরনের সংকট স্বীকার করে তা সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তাতে অর্থনৈতিক মূল্য কিছুটা কম দিতে হয়।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই ব্যাংক খাতনির্ভর। ২০২৪ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতের মোট সম্পদমূল্য ২১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের আর্থিক খাতের মোট সম্পদের ৮৮ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৫০ শতাংশ। ব্যাংকিং খাতের মোট সম্পদের মধ্যে ৭০ শতাংশ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের, ২৫ শতাংশ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের এবং ৪ শতাংশ বহুজাতিক বিদেশি ব্যাংকগুলোর।
বিশ্বব্যাংক বলছে, এ দেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিন ধরে অদক্ষতা ও কাঠামোগত দুর্বলতা, দুর্বল সুশাসন, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কুক্ষিগত করা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বিতরণের সমস্যায় ভুগছে। আইনি ফাঁকফোকরের মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্ককে ব্যবহার করে নানা ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হলেও এক পরিবারের সদস্যদের পর্ষদে থাকার মেয়াদ ১২ বছরে উন্নীত করার মাধ্যমে এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
দেশের অর্থনীতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের একটি তথ্য উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ২০২৩ সালে আটটি ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে পারস্পরিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার। এই তথ্য প্রমাণ করে কীভাবে ব্যাংকগুলো পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটিয়েছে। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয়টি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের আলাদা আলাদা কার্যক্রমের বিষয়টি গুরুত্ব হারিয়েছিল। ২০১৭ সালে একটি গোষ্ঠী এককভাবে সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হলেও এক পরিবারের সদস্যদের পর্ষদে থাকার মেয়াদ ১২ বছরে উন্নীত করার মাধ্যমে এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছিল। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর দুর্বল সুশাসনের বিষয়টি দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এক সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান না হওয়ায় তা বিশাল আর্থিক ক্ষতি ও আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যেমন ব্যাহত করে, তেমনি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও দুর্বল করে দেয়। এর ফলে বছরে গড়ে জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ ক্ষতি হয়।
বিশ্বব্যাংক বলছে, বিশ্বজুড়ে ব্যাংকিং সংকটের সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশও ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতার জন্য অর্থনৈতিক নানা সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। ১৯৭০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৫১টি ব্যাংকিং ব্যবস্থার পদ্ধতিগত সংকট বিশ্লেষণের তথ্য তুলে ধরে সংস্থাটি বলছে, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যেমন ব্যাহত করে, তেমনি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও দুর্বল করে দেয়। এর ফলে বছরে গড়ে জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ ক্ষতি হয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করতে ১০টি সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। উৎস: প্রথম আলো।