চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের নবম মাস মার্চে ৪২ হাজার ৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। এর মধ্যে আহরণ হয়েছে ৩৪ হাজার ৬৬৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর মধ্য দিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট রাজস্ব আহরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকায়। যদিও এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় এ নয় মাসে মোট ৩ লাখ ২২ হাজার ১৫২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। এ সময় পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৭৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ সে অনুযায়ী অর্থবছরের প্রথম নয় মাস শেষে এনবিআরের রাজস্ব আহরণে ঘাটতির হার দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র: বণিক বার্তা
লক্ষ্যের তুলনায় ঘাটতি থাকলেও এ সময় রাজস্ব আহরণে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধির দেখা পেয়েছে এনবিআর। সংস্থাটির হিসাবে একক মাস হিসেবে চলতি অর্থবছরের মার্চে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মোট রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাস (জুলাই-মার্চ) পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৯২ দশমিক ২৩ শতাংশ রাজস্ব আহরণ করেছিল এনবিআর। এর মধ্যে কাস্টমস থেকে ৮৯ দশমিক ১১ শতাংশ, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে ৯৫ দশমিক ৮৬ ও আয়কর থেকে ৯০ দশমিক ৯৫ শতাংশ আয় হয়। গত অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। জুলাই-মার্চ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৮১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার বিপরীতে আয় হয় ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছিল ৯২ দশমিক ২৩ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাস পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৭৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। এর মধ্যে কাস্টমস থেকে ৮১ দশমিক ৮৪ শতাংশ, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট থেকে ৮৩ দশমিক ৬ ও আয়কর থেকে ৭৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় এনবিআরকে। রাজস্ব আহরণের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, গত মার্চ পর্যন্ত এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ২২ হাজার ১৫২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত আহরণ হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। মার্চ পর্যন্ত সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার হিসাবে রাজস্ব আহরণ ৭৯ দশমিক ৬২ শতাংশ অর্জন হলেও মোট সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে। আর গত অর্থবছরের একই সময় পর্যন্ত আদায় হয়েছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার ৫৯২ কোটি ৩১ লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধির হিসাবে এটি ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের মার্চের রাজস্ব আহরণের সাময়িক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের তুলনায় বড় ধরনের ঘাটতি হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে আয়কর ও ভ্রমণ কর, মূসক এবং আমদানি-রফতানি খাতে শুল্ক ও মূসক বাবদ আহরণ। এর মধ্যে আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে ঘাটতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় এ বাবদ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ১ লাখ ১৬ হাজার ৬৭৬ কোটি ২০ লাখ টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৮৬ হাজার ৯২০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৭৪ দশমিক ৫০ শতাংশ, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৯ দশমিক ৩২ শতাংশ কম। তবে আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। একক মাস হিসেবে শুধু মার্চে ১৭ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ১৩ হাজার ৭৬৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এ খাতে মোট সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা।
এ নয় মাসে স্থানীয় পর্যায়ে মূসক বাবদ আহরণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৯ কোটি ১৬ লাখ টাকার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৯৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। এ খাতে এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৮৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৪ দশমিক ৪২ শতাংশ কম। তবে এ নয় মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে একক মাস হিসেবে মার্চে মূসকের প্রবৃদ্ধি মাত্র ১ দশমিক ১৮ শতাংশ। এ মাসে ১৩ হাজার ৭৭০ কোটি ১৬ লাখ টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ১১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। স্থানীয় পর্যায়ে মূসকের মোট সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা।
ঘাটতির বিষয়ে এনবিআরের সদস্য (ভ্যাট বাস্তবায়ন ও আইটি) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে একটা বড় সময় চলে গেছে। তখন আহরণ বন্ধ ছিল। এছাড়া বিপিসির দেয়া ৫ হাজার কোটি টাকাও মার্চের হিসাবে আসেনি। কারখানা স্থানান্তর জটিলতার কারণে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো থেকেও দেড় হাজার কোটি টাকা কম আয় হয়েছে। এপ্রিলে এ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকাসহ মোট আহরণ বাড়বে।’
চলতি অর্থবছরে আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে মোট সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ২০ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। মার্চ পর্যন্ত ৯০ হাজার ৭২৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৭৪ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। এ খাতে এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৮১ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা মোট সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে ৩৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তবে আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৩৮ শতাংশ। শুধু মার্চে ১০ হাজার ৯৪৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ৯ হাজার ৮১৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের এ তথ্য সঠিক নয়। আইবাস এখনো সব রাজস্ব রিয়াল টাইম দেখাতে পারে না। যেমন আইবাসে সম্পূরক শুল্ক বা রেগুলেটরি শুল্কের কোড নেই। কাস্টমস খাতে প্রকৃতপক্ষে আহরণ ৭৭ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা, যা বিগত বছরের চেয়ে প্রায় ৭ শতাংশ বেশি। তবে আমদানি প্রবৃদ্ধির তুলনায় এ হার ১ শতাংশ কম। চিনি, ভোজ্যতেল, চাল ইত্যাদি পণ্যে জনকল্যাণে ছাড় দিয়ে শূন্য হারে আমদানি করা হয়েছে। এসব পণ্য আমদানি ব্যাপক হারে বেড়েছে। যদিও এতে শুল্ককর আসেনি তেমন। তাছাড়া বিপিসি ও পেট্রোবাংলার আর্থিক সংকটের কারণে ব্যাপক বকেয়া রেখেই পণ্য খালাস দিতে হয়েছে।’
সার্বিক বিষয়ে এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লক্ষ্যমাত্রা বেশি ধরা হয়েছে। আয় ঠিকই আছে। মার্চের আয় তো বিগত মাসগুলোর তুলনায় ঠিক আছে। বিধ্বস্ত ও ধীরগতির অর্থনীতিতে গতানুগতিক রাজস্ব বোর্ড দিয়ে এর চেয়ে বেশি রাজস্ব আয় সম্ভব নয়। জাতীয় অর্থনীতি বিধ্বস্ত। সে কারণে ধীরগতির হলেও তাতেও রাজস্বের যা সম্ভাবনা আছে, যথাযথ সক্ষমতা না থাকায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষে তাও আয় করা সম্ভব নয়। আগামী তিন মাসের আয়ও আশানুরূপ না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এখনো আমদানি পর্যায়ের আয়ই বেশি। ভ্যাট দ্বিতীয় ও আয়কর তৃতীয়। অথচ সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা আয়কর, ভ্যাট দ্বিতীয় আর কাস্টমস তৃতীয়। যতক্ষণ রাজস্ব আয়ে এ ধারা চালু না হবে, ততক্ষণ রাজস্ব আয় আশানুরূপ হবে না।’
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বণিক বার্তাকে বলেন, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের আদায়ের তুলনায় এ বছরের প্রথম ৯ মাসে ৬ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়েছি। আমি কাস্টমস, ভ্যাট এবং আয়কর বিভাগের আমার সহকর্মীদের এর কৃতিত্ব দিতে চাই। আমরা যদি রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটন, নতুন করদাতা শনাক্তকরণ এবং যারা আয়কর রিটার্ন এবং ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করছেন না তাদের কাছ থেকে আইনানুগ কর আদায় করতে পারি এবং করদাতাদের সচেতনতা বাড়াতে পারি, তবে রাজস্ব আদায় অনেক বাড়ানো সম্ভব হবে। আমি আশা করছি আগামী ৩ মাসে রাজস্ব সৈনিকদের সর্বাত্মক প্রয়াসের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম আরো বেগবান হবে।‘