বিশ্বব্যাংকের কাছে প্রতিশ্রুত বাজেট সহায়তার বাকি ৫০০ মিলিয়ন ডলার দ্রুত ছাড় করার অনুরোধ জানাবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া সংস্থাটির তিন বছর মেয়াদি নতুন সহজ শর্তের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাড়তি ঋণও চাইবে।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ বসন্তকালীন বৈঠকে (২১-২৬ এপ্রিল) বিনিময় হার ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সুস্পষ্ট সংস্কার পরিকল্পনা উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ—যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্যাকেজের অন্যতম শর্ত।
এ পর্যন্ত—গত বছরের জুন অবধি—আইএমএফ তিন কিস্তিতে মোট ২.৩ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে, যা মোট প্রতিশ্রুত অর্থের অর্ধেক। চলতি বছরের জুনের মধ্যে প্রত্যাশিত ১.৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের বিষয়টি নিশ্চিত না করেই আইএমএফের একটি মিশন গত সপ্তাহে ঢাকা ছেড়েছে।
বাড়তি অর্থায়ন নিশ্চিতের জন্য জোর প্রচেষ্টা: প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত ছাড় করার অনুরোধের পাশাপাশি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিনির্ভর অবকাঠামো প্রকল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মানব উন্নয়ন প্রকল্পে বাড়তি অর্থায়ন চাইবে বলে জানিয়েছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা।
এছাড়াও প্রস্তাবিত বে টার্মিনাল গভীর সমুদ্র প্রকল্পের জন্য সামুদ্রিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা রয়েছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। গত বছরের জুনে অনুমোদন পাওয়া এই ঋণের অর্থে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ জলবায়ু-সহনশীল ব্রেকওয়াটার নির্মাণ করা হবে, যা জোয়ারের প্রভাব থেকে বন্দরকে রক্ষা করবে।
আলোচনায় ঢাকার চারপাশের নদী রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের ১ বিলিয়ন ডলারেরও প্রতিশ্রুতিও গুরুত্ব পাবে। আলোচনা সন্তোষজনক হলে অক্টোবরের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে।
ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে অংশ নিতে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী ও অর্থ বিভাগের সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার।
সহজ শর্তে আরও ঋণ চায় বাংলাদেশ: বাংলাদেশ এখন মিশ্র অর্থায়নের (ব্লেন্ডেড ফাইন্যান্সিং) জন্য যোগ্য হলেও বিরাজমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে সরকার ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত চলমান আইডিএ-২১ 'সফট-লেন্ডিং' ধাপের আওতায় সহজ শর্তের ঋণ আদায়ের ওপরই জোর দেবে।
বিশ্বব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ৫১টি চলমান প্রকল্পে মোট আইডিএ প্রতিশ্রুতি ১৪.৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৯.২ বিলিয়ন ডলার এখনও ছাড় করা হয়নি। ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রকৃত ছাড় হয়েছে ৯৭৯ মিলিয়ন ডলার।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ ও ফেডারেল রিজার্ভ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করার কথা রয়েছে।
সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও নীতিগত পদক্ষেপ: সভার জন্য অর্থ বিভাগের প্রস্তুতকৃত ব্রিফিংয়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যেগুলো মোকাবিলায় কৌশলগত নীতিগত হস্তক্ষেপের প্রয়োজন।
যদিও মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে, তবে প্রবাসী আয় কিংবা রপ্তানি আয় কমে গেলে পুনরায় অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কিংবা রপ্তানি কমে গেলে ফের অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে। আমদানি ব্যয় বাড়লে উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নেওয়া অর্থনীতির ওপর আরও চাপ তৈরি হতে পারে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি বাস্তবায়ন করেছে কর্তৃপক্ষ—যার প্রভাব পড়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে, আমদানিমূল্য কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে এবং কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া নীতিগুলো ইতিবাচক ফল দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধান আমদানি উৎস—চীন ও ভারতে—মূল্যস্ফীতি কম এবং টাকা-ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকায় আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি কমেছে।
তবে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জগুলো রয়ে গেছে। সরবরাহ চেইনে ব্যাঘাত, অতিরিক্ত মুনাফার মার্জিন, চড়া পরিবহন ব্যয়, ঘুস ও চাঁদাবাজি সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কার্যকারিতা কমিয়ে দিচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ চড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। তার সঙ্গে আঁটসাঁট রাজস্ব ও মুদ্রানীতির প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। আগামী বছর প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নামতে পারে, তবে ২০২৭-২৮ অর্থবছর নাগাদ প্রবৃদ্ধি ফের ৬ শতাংশের ওপরে উঠবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
কাঠামোগত দুর্বলতা ও এলডিসি থেকে উত্তরণের কৌশল: তিবেদনটিতে স্বীকার করা হয়েছে, রাজস্ব আদায় প্রত্যাশার নিচে থাকায় এবং ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়ায় সরকারের আর্থিক পরিসর সংকুচিত হচ্ছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগেও গতিমন্থরতা রয়েছে। এর অন্যতম কারণ: জ্বালানি ঘাটতি, চড়া সুদহার, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং দুর্বল ঋণমানদণ্ড, ব্যাপক খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট, সুশাসনের ঘাটতি ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অদক্ষতার মতো আর্থিক খাতের নানা দুর্বলতা।
এসব উদ্বেগের সঙ্গে জলবায়ু ঝুঁকি গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে, বিশেষ করে কৃষিকে হুমকির মুখে ফেলছে। বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য প্রস্তুতি হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য বাজারে প্রবেশাধিকার ও সহজ শর্তের ঋণপ্রাপ্তি অব্যাহত রাখতে জোরালো মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ।
অবকাঠামো উন্নয়ন ও দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগ: অবকাঠামো বিনিয়োগের গুরুত্ব স্বীকার করে সরকার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উন্মোচন করার জন্য বৃহৎ আকারের প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তবে এই মেগাপ্রকল্পগুলোকে ঘিরে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্পগুলো বাদ দিয়ে সামাজিক খাতে বিনিয়োগ, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় অগ্রাধিকার দিতে চায়।
রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকার ত্রিমুখী কৌশল নিয়েছে: ১. ডিজিটাল রূপান্তর, ২. প্রত্যক্ষ করজালের আওতা বৃদ্ধি এবং ৩. কর প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও করছাড় কমানো।
বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনও ৮ শতাংশের নিচে, যা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। এই পরিসংখ্যানই বলছে, বাংলাদেশে ব্যাপক কর সংস্কার প্রয়োজন।
কান্ট্রি পারফরম্যান্স গুরুত্বপূর্ণ : বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের জন্য আইডিএ বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়টি নির্ভর করে কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইন্সটিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট-এ (সিপিআইএ) বাংলাদেশ কেমন করছে, তার ওপর।
'সিপিআইএর ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রয়েছে। বাংলাদেশ যদি স্কোর বাড়াতে পারে, বিশেষ করে সুশাসনের ক্ষেত্রে, তাহলে দেশের বরাদ্দ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণে আলোচনায় বাংলাদেশ সে ধরনের সংস্কারের বিষয় আনতে পারে,' বলেন তিনি।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, কিছু সংস্কার ইতিমধ্যেই করা হয়েছে। 'যেমন বিদ্যুৎ খাতের বিশেষ আইন বাতিল করা হয়েছে। এটা সিপিআই হিসেবে ধরা হয়েছে কি না, তা বিবেচনার বিষয়। দুর্নীতি দমন কমিশনকে পুনর্গঠন করা হলো, এটা একটা গভর্ন্যান্স ইস্যু। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে সংস্কার করা হয়েছে।'
'ইতিমধ্যে যা করা হয়েছে এবং আগামীতে আমরা যা করব—এমন কিছু যদি তারা দেখাতে পারে, তাহলে বরাদ্দ বাড়ার বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কান্ট্রি বরাদ্দ বাড়াতে এটাই হলো পথ,' যোগ করেন তিনি।
বাজেট সহায়তা প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, আইএমএফ সম্মতি না দিলে বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তা পাওয়া কঠিন হবে।
এই অর্থনীতিবিদ পরামর্শ দেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের উচিত হবে কর নীতিকে কর প্রশাসন থেকে আলাদা করা, করছাড় কমানোসহ আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী প্রতিশ্রুত সংস্কার পরিকল্পনাগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। 'দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নিয়ে (আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য) শুধু সময় চাওয়া ভুল বার্তা দেবে।' উৎস: বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।