এল আর বাদল ; বাংলাদেশে গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের লোডশেডিং এর আশঙ্কা বাড়ছে। শহরের তুলনায় গ্রামে তুলনামূলক লোডশেডিং বেশি হচ্ছে বলে জানা গেছে। এখনো তীব্রতা না বাড়লেও সামনের সপ্তাহগুলোয় লোডশেডিং আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
এ বছর গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ হাজার মেগাওয়াট হতে পারে বলে পূর্বানুমান (ফোরকাস্ট) করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। -- সূত্র, বিবিসি বাংলা
সে অনুযায়ী ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনেরই চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
যদিও সংস্থাটির দেয়া তথ্যই বলছে এখন এপ্রিলে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। ফলে সেই হিসেবে তা ভরা গ্রীষ্ম মৌসুমে একই বা কিছু বেশি বা কম হতে পারে।এ হিসেবে লোডশেডিং হতে পারে প্রায় চার হাজার মেগাওয়াটের।
যদিও কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি সংকট বা অতিরিক্ত খরচ বাড়াতে না চাইলে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হতে পারে।
বিপিডিবির সদস্য (উৎপাদন) মো. জহুরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, " এ বছর ফুল সামারে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ ১৮ হাজার মেগাওয়াট ফোরকাস্ট করা হয়েছে। ১৮ হাজারই উৎপাদনের চেষ্টা করতেছি আমরা। যদি এইচএফও কম চালাই অল্প কিছু লোডশেডিং হবে। ফলে তখন এক বা দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হতে পারে।"
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, অন্যান্য রাজনৈতিক সরকারের মতো এই সরকারও জ্বালানির ক্ষেত্রে সেই একই পথে হাঁটছে।
"আদানির কাছ থেকে ডলার দিয়ে বিদ্যুৎ না কিনে সেটা দিয়ে কয়লা কিনে সরবরাহ করলে তার থেকে দ্বিগুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি আমরা। ফার্নেস তেল-চালিত জ্বালানি কয়লার চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল" বলেন মি. আলম।
-- লোডশেডিং এর চিত্র---
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ গতকাল সোমবার সারাদেশে লোডশেডিং ছিলো কেবল ৬৭ মেগাওয়াট।
ওইদিন রাত নয়টা পর্যন্ত ১৪ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৪৮০ মেগাওয়াট। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন বিকেলে পিক আওয়ারে এই ৬৭ মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিলো।
এ বছর রোজার সময় সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ মোটামুটি নিরবচ্ছিন্ন ছিল। এরই মধ্যে সরকার জানিয়েছে এই ধারাবাহিকতায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানী উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কয়েকদিন আগে গণমাধ্যমে বলেছেন, "রমজানের মতো অতোটা হয়তো সম্ভব হবে না, তবে চেষ্টা করবো যতটা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়। লোডশেডিং এবার যদি হয় এটা এমন হবে না যে খালি গ্রামে লোডশেডিং হবে। ঢাকাতে প্রথম লোডশেডিং হবে তারপরে অন্য জায়গায় লোডশেডিং হবে। "
বিপিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। তবে জ্বালানি সংকট, উচ্চ ব্যয়ের কারণে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে।
সংস্থাটির সদস্য মি. ইসলাম বলেন, " সামারে আমরা লোডশেডিং করবো। কারণ না করলে এইচএফও মেশিন চালালে খরচ অনেক বেড়ে যায়। বাংলাদেশে এখন পাওয়ার প্ল্যান্টে প্রচুর মেশিন আছে। শুধু সমস্যা হচ্ছে জ্বালানি সরবরাহ করা। জ্বালানি বাজারে এভেইলেবল কিন্তু ব্যয়বহুল। এজন্য কিছু লোডশেডিং করা। তবে আমাদের চেষ্টা হচ্ছে লোডশেডিং না করা।
এরইমধ্যে কয়লাভিত্তিক দুইটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আদানি ও মাতারবাড়ি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ প্রাপ্তি নিয়ে সঙ্কট লোডশেডিং সমস্যাকে আরও প্রকট করতে পারে।
কারিগরি ত্রুটির কারণে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডায় নির্মিত আদানি গ্রুপের কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় গত শুক্রবার রাতে।
১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে এই কেন্দ্রের। এই ইউনিট দুইটি ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার।
পরে শনিবার সন্ধ্যায় একটি ইউনিট থেকে আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। এই ইউনিট থেকে ছয়'শো মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ নেওয়া হচ্ছে।
মি. ইসলাম জানান, "আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি মেশিন থেকে এখন বিদ্যুৎ নেওয়া হচ্ছে। আরেকটা মেশিন মেইনটেন্যান্সে আসছে। সেটা হয়তো পাঁচ - সাতদিনের মধ্যেই চলে আসবে। আমাদের দুইটা মেশিন থেকেই ম্যাক্সিমাম বিদ্যুৎ নেওয়ার প্ল্যান আছে।
ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহে চাপ কিছুটা পড়ছে বলে স্বীকার করে নেন বিপিডিবির এই কর্মকর্তা। এছাড়া কয়লার সঙ্কটে রয়েছে এক হাজার দুইশ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
মি. ইসলাম বলেন, " মাতারবাড়ি মেশিন এখন চলতেছে।.... আরেকটা মেশিন মেইনটেন্যান্সে আছে। কিন্তু ওখানে কয়লার ক্রাইসিস আছে। কয়লার কোয়ালিটি খারাপ হওয়াতে মাতারবাড়ি কোম্পানি ওই কয়লাগুলো ফেরত দিয়েছে। এটা পিডিবির নয়। আশা করি অচিরেই কয়লা আসবে। কয়লা আসলে মেশিনগুলো আবার চালাবে।"
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেশিনে সমস্যা হলে চাপ পড়বে এটাই স্বাভাবিক।
তবে ৫০০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটে সমস্যা হলে আরেকটা ৫০০ মেগাওয়াটের ইউনিট চালু হয়ে যায় বলে দাবি করেন বিপিডিবির এই কর্মকর্তা।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "মেঘনাঘাটে সামিটের একটা মেশিন আজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মেশিনের সমস্যা হলে তো চাপ (বিদ্যুৎ সরবরাহে) আসেই। মেশিন ক্রমাগত কিছু বন্ধ হচ্ছে আবার কিছু চালু হচ্ছে। কিন্তু আবার বিবিয়ানায় সামিটের আরেকটা মেশিন এসেছে। এছাড়া আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে।"
বাংলাদেশে এখন ১৫০টির মতো বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে বলে জানান তিনি।
তবে এপ্রিল মাস থেকে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাস পর্যন্ত গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেশিনগুলো একটানা চালানো যায় না বলে জানান মি. ইসলাম।
ফলে একই সময়ে সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র কার্যকর না থাকলেও কোন সমস্যা হয় না বলে মনে করেন বিপিডিবির এই কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম।
তবে গ্রীষ্মের ভরপুর মৌসুমে লোডশেডিং সরকার কিভাবে সামাল দেবে এমন প্রশ্নে মি. ইসলাম বলেন, " সরকার যদি বলে লোডশেডিং করবো না তাহলে ব্যয়বহুল জ্বালানি খরচ করে যেমন পার ইউনিট ৪০ বা ৪৫ টাকা খরচ করে সেই মেশিনগুলো চালাতে হবে। এটা সামাল দেওয়ার কিছু নাই। সরকার যদি বলে লোডশেডিং করবো না, তাহলে মেশিন ও ফুয়েল দুইটাই আছে। সাবসিডি কমানোর জন্য এটা করা।"
শুধুমাত্র কয়লা ও গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎ-কেন্দ্রের ক্ষেত্রে জ্বালানি সংকট রয়েছে বলে জানান বিদ্যুতের এই কর্মকর্তা।
-- ফার্নেস ওয়েলে বিদ্যুৎ উৎপাদন আত্মঘাতী---
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদনও চাহিদা অনুযায়ী হয় না। ফলে সরকার লোডশেডিং এর দিকে ঝুঁকে।
তাদের অভিযোগ, লোডশেডিং দিয়ে সরকার জ্বালানি ব্যয় কমাচ্ছে, ঝুঁকছে ব্যয়বহুল ফার্নেস ওয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, "রাজনৈতিক সরকারের আমলে যেমন ছিল এই সরকারও একই পথে হাঁটছে। আদানির কাছ থেকে ডলার দিয়ে বিদ্যুৎ না কিনে সেটা দিয়ে কয়লা কিনে সরবরাহ করলে তার থেকে দ্বিগুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি আমরা।
বছরে এক কোটি ২০ লাখ টন কয়লা খরচ করার মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে বলে উল্লেখ করেন মি. আলম। তিনি অভিযোগ করেন, এসব কারণে আগের রাজনৈতিক সরকারের মতো এ সরকারও ফার্নেস তেল-চালিত বিদ্যুৎ-কেন্দ্রের দিকে ঝুঁকছে যা ব্যয়বহুল। যাতে কয়লা-চালিত বিদ্যুতের থেকে খরচ বেশি।
যদিও কয়লার ব্যবহার বৃদ্ধি নিয়ে পরিবেশ কর্মীদের আপত্তি রয়েছে।
অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে পারি যদি কয়লা সাপ্লাই দিতে পারি। কিন্তু আমরা আসলে কয়লা সাপ্লাই দেওয়ার জন্য যে ব্যয় বৃদ্ধি করা দরকার সেটা করতে চাচ্ছি না। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে আর্থিক ঘাটতি বাড়াতে চাচ্ছি না।
কিন্তু আর্থিক ঘাটতি বাড়াতে না চাইলে মূল্যবৃদ্ধি করতে হবে। এটা না করতে চাইলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে হবে। উৎপাদন কমাতে হলে লোডশেডিং করতে হবে।"
এ ধরনের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী কাজ বলে উল্লেখ করেন মি. আলম।
এটা আত্মঘাতী কাজ। এটা অর্থনীতি, দেশ ও সরকারের জন্য আত্মঘাতী কাজ। জ্বালানি ব্যয় কমানোর জন্য অফ - পিক পিরিয়ডে লোডশেডিং দিলে মানুষের ভোগান্তি কমবে। অর্থাৎ রাতের পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন থাকলে জীবন সহজ হবে" বলেন তিনি।