শিরোনাম
◈ পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার কাজের অগ্রগতি কেমন? ◈ দেশের রিজার্ভ বেড়ে ২৬ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার ◈ আরও ৭ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন ◈ স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম আগের বছরের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার ছোট হচ্ছে ◈ স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে নারী বিশ্বকা‌পের মূলপর্বের দ্বারপ্রা‌ন্তে বাংলাদেশ ◈ আমরা খেলেছি গাজার জন্য, আন্ডারডগ হ‌য়েও চ্যাম্পিয়ন ফিলিস্তিনের মেয়েরা ◈ ১৫ বছর পর পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠকে বসছে ঢাকা-ইসলামাবাদ ◈ আমাদের পূর্ণ গতিতে এগোতে হবে: প্রধান উপদেষ্টা ◈ বজ্রপাতে নেত্রকোনায় তিনজন নিহত ◈ বাংলাদেশে ফের পূর্ণ সক্ষমতায় আদানির  দুই ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে

প্রকাশিত : ১৫ এপ্রিল, ২০২৫, ০১:৫৭ রাত
আপডেট : ১৬ এপ্রিল, ২০২৫, ০৪:০৮ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি: ঝুঁকিতে নতুন বিনিয়োগ?

ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন।। সরকার সম্প্রতি বিনিয়োগ সম্মেলন করে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহবান জানিয়েছে৷

এই সম্মেলন শেষ হতে না হতেই নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে৷

প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা বাড়তি দিতে হবে তাদের৷ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্ববিরোধী বলছেন উদ্যোক্তারা৷ পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগকারীরা এতে আশাহত হবেন এবং নতুন বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে বলেও মনে করছেন তারা৷

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘হঠাৎ করে এই মূল্যবৃদ্ধিতে দেশে-বিদেশে খারাপ বার্তা যাবে৷ নতুন বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাবেন না৷ ফলে দেশে শিল্প কলকারখানা স্থাপনে স্থবিরতা নেমে আসবে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমনিতেই আমাদের পণ্যে সাড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়৷ এর সঙ্গে সম্প্রতি আরও ১০ শতাংশ যোগ হয়েছে৷ এতেই আমরা অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি৷ এরপর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি আমাদের দারুণভাবে হতাশ করেছে৷ আমরা এমনিতেই প্রতিযোগিতা থেকে পিছয়ে পড়ছি, এতে আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা আরও কমে যাবে৷ এখন তো সরকার ঠিকমতো গ্যাসই দিতে পারছে না৷ প্রায়ই মিটার জিরোতে চলে আসে৷ উৎপাদন ঠিক রাখতে আমাদের ডিজেলের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে৷ সবমিলিয়ে কী পরিমাণ খরচ বাড়বে, সেটা এফোর্ট করার সক্ষমতা কি আমাদের আছে?''

তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘এতে কোনো বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে না৷ বরং বিনিয়োগকে মজবুত করবে৷ আমাদের মনে রাখতে হবে, গ্যাসের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে৷ আমরা সেই ঘাটতি মেটানোর জন্য এলএনজি আমদানি করছি৷ এটা আমদানির মূল্য হচ্ছে ৭০ টাকার মতো৷ এখন শিল্পে গ্যাসের দাম ৩০ টাকার মতো৷ এখন ৪০ টাকা ভর্তুকি দিয়ে আপনি কতদিন চালাবেন? জ্বালানি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ এখনই ২০ হাজার কোটি টাকা৷ এটা দিন দিন বাড়ছে৷ এখন গ্যাসের এই বৃদ্ধির ফলে দাঁড়িয়েছে ৪০ টাকার মতো৷ তারপরও ৩০ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে৷ এই মূল্যবৃদ্ধিটা একটা সিগন্যাল এই কারণে যে, গ্যাস কমে যাচ্ছে৷ ফলে ব্যবসায়ীরা প্ল্যান করবেন, গ্যাস এফিসিয়েন্ট মেশিন তারা আনবেন, গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপিজি ব্যবহার করবেন৷ এখনই যদি আমরা এই সিগন্যাল না দেই তাহলে আরো শিল্প কলকারখানা হলো কিন্তু তাদের তো আমরা ৭০ টাকা দিয়ে এলএনজি আমদানি করে ৩০ টাকায় দিতে পারবো না৷''   

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদনশীল খাতে কতটা প্রভাব পড়বে? জানতে চাইলে হান্নান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি এ বি এম শামসুদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নানা চ্যালেঞ্জের কারণে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে৷ এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক, দেশে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে আমরা প্রতিযোগিতা থেকে প্রতিনিয়ত পিছিয়ে যাচ্ছি৷ এবার যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলো, কী কারণে এটা করা হলো? কোনো সদুত্তর তারা দিতে পারেনি৷ আগের সরকার দুই বছর আগে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার কথা বলে ১১ টাকা থেকে ৩০ টাকা করেছিল৷ সেই প্রতিশ্রুতি তারা রাখেনি৷ এখন আবার বাড়ানো হলো৷ এভাবে চললে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকবে না৷''

এখনই তো শিল্প কারখানায় গ্যাসের চাপ নেই, তারা বিকল্পভাবে উৎপাদন ঠিক রেখেছেন৷ গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধিতে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা? জবাবে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘‘সেই কারণেই তো মূল্যবৃদ্ধি৷ আমরা পাইপলাইনে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির চেষ্টা করছি৷ এখন আমাদের গ্যাসের চাহিদা ৪ হাজার এমএমসিএফডি (মিলিয়ন স্ট্যান্ডার্ড কিউবিক ফিট পার ডে) অর্থাৎ ৪০০ কোটি ঘনফুট৷ কিন্তু দিতে পারি ২ হাজার ৮০০ থেকে ৯০০ এমএমসিএফডি (২৮০-২৯০ কোটি ঘনফুট)৷ ফলে এক হাজারেও বেশি ঘাটতি রয়েছে৷ সেটা তো পূরণ করতে হবে৷ একটা জিনিস বুঝতে হবে, যেখান থেকে গ্যাসের পাইপ লাইন শুরু হয়, তার শেষ মাথায় গিয়ে কিন্তু চাপ কমে যায়৷ কিন্তু সরবরাহ বাড়াতে পারলে এটা ঠিক রাখা সম্ভব৷ আমরা সেই চেষ্টাটাই করছি৷''

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে ভোক্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের তীব্র আপত্তি ছিল৷ তারপরও রবিবার বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম৷ নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৩ শতাংশ৷ প্রতি ইউনিটে ১০ টাকা বাড়তি দিতে হবে তাদের৷ পুরোনো শিল্পকারখানায় অনুমোদিত লোডের বাইরে অতিরিক্ত ব্যবহারে দিতে হবে বাড়তি দাম৷ প্রতিশ্রুত শিল্প গ্রাহকদের অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে বাড়তি দাম দিতে হবে৷

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ‘‘দেশের গ্যাস কমার সঙ্গে সঙ্গে এলএনজি আমদানি বাড়তে থাকে৷ এলএনজির বাড়তি দাম দিতে গিয়ে চাপে পড়ে পেট্রোবাংলা৷ তারা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল৷''

তবে গণশুনানিতে বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী দাম বাড়ানো নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল৷ কিসের ভিত্তিতে দাম বাড়ানো হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে বিইআরসির চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব চাহিদা ধরলে দাম অনেক বেশি বাড়াতে হতো৷ তাই ভোক্তার জন্য সহনীয় রাখতে ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে ভর্তুকিরও হিসাব করা হয়নি৷ রাজস্ব চাহিদা যাচাই ছাড়া এভাবে মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের প্রেসক্রিপশনে করা হয়নি৷

নতুন ও পুরোনো শিল্পে আলাদা দাম রেখে যে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে, এটা আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, বিইআরসির আইনি আওতার মধ্যে থেকেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে৷ এতে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিনিয়োগ কমার বিষয়টা এখনই বলা যাবে না৷ নতুন বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে কি না, তা নজরে রাখা হবে৷ নতুন যারা আসবে, তারা যদি দেখে তাদের পোষাবে, তাহলে তারা আসবে৷ তারা বিকল্প জ্বালানিও ব্যবহার করতে পারে৷

সরকারের নীতিনির্ধারকরা দেশের কারখানা বন্ধ করে দেশটাকে আমদানি নির্ভর করতে চান বলে মনে করেন কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘‘কাদের পরামর্শে এটা করা হচ্ছে? যারা পরামর্শ দিচ্ছে তারাও জানেন এগুলো করলে ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে৷ দেশটাকে আমদানি নির্ভর করা যাবে৷ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন কারখানা তো হবেই না, পুরনো কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে৷ সরকার যেটা চাচ্ছে এলএনজির মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করতে৷ দেশে গ্যাস উৎপাদনের কোনো আগ্রহ নেই, আমদানি নির্ভর করতে পুরোপুরি এলএমজির উপর নির্ভরশীল করা চেষ্টা হচ্ছে৷ আমরা গণশুনানিতে সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে যুক্তি তুলে ধরেছিলাম৷ কিন্তু তারা কিছুই শোনেনি৷''

বিইআরসির আদেশ বলছে, শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে (ক্যাপটিভ) ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ছিল ৩১ টাকা ৫০ পয়সা৷ এটি বেড়ে হয়েছে ৪২ টাকা৷ আর শিল্প সংযোগে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪০ টাকা৷ নতুন এ দাম রোববার থেকেই কার্যকর হবে৷ ১৩ এপ্রিল এর পরে যত গ্যাস সংযোগ অনুমোদন করা হবে, তাদের বাড়তি দাম দিতে হবে৷ এর আগ পর্যন্ত যেসব সংযোগ আবেদনের চাহিদাপত্র ইস্যু করা হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে নতুন দাম৷ আর পুরোনো শিল্প গ্রাহকেরা অনুমোদিত লোডের বাইরে যতটুকু ব্যবহার করবেন, ততটুকুর নতুন দাম দিতে হবে৷

এর আগে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয় শিল্পে গ্যাসের দাম৷ শিল্প ও ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটের দাম ১১ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৩০ টাকা৷ পরে গত বছর ক্যাপটিভে দাম বাড়িয়ে করা হয় ৩১ টাকা ৫০ পয়সা৷ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা বলছেন, যেখানে নতুন সরকার একদিকে সার্বিক বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক ওই সময় এ গ্যাসের দাম বাড়ানো ‘উল্টো নীতি' নেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত৷ এতে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে৷ এছাড়া প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইও কমবে৷

নিট পোশাক রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘শিল্প গ্যাসের দাম আগে ৩০ টাকা ছিল, সেটাই নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল৷ এরপর আরও দাম বাড়ালে নতুন করে শিল্প স্থাপনের আগ্রহ হারাবেন বিনিয়োগকারীরা৷ সরকার একদিকে বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলছে, আবার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে৷''

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘যে-কোনোভাবেই খরচ বাড়ানো ওই খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমিয়ে দেয়৷ পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রেও অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের চেয়ে আমরা পিছিয়ে যাব৷ গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও সরবরাহ তো ঠিক হবে না? এ সমস্যায় শিল্পগুলো অনেকদিন ধরে ভুগছে৷ পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিও অনেক সমস্যার মধ্যে রয়েছে৷ আমরাও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট ইস্যু নিয়ে চিন্তিত৷ ঠিক সে সময় এ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সমন্বয় কঠিন হবে ব্যবসায়ীদের জন্য৷ বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোর মালিকরা বড় সমস্যায় পড়বে ন৷''

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়