মনজুর এ আজিজ : বিশ্বে ৩৫তম আর দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ হলেও বৈদেশিক বিনিয়োগে পিছিয়ে বাংলাদেশ। অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৭১ শতাংশ। এসময় বৈদেশিক বিনিয়োগ ৭৬.৭৯ মিলিয়ন ডলার। সেটিও গেল অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ শতাংশ কম। বিনিয়োগ কমার পেছনে অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও ছয় মাসে সামগ্রিক রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
আইএমএফের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে নাম উঠে এসেছে বাংলাদেশের। আর দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ। তবে বৈদেশিক বিনিয়োগে কী অবস্থা? সার্বিকভাবে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির এ চাকা ইতিবাচক থাকলেও বৈদেশিক বিনিয়োগে পড়েছে ভাটা।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই ৩৬০.৫ মিলিয়ন থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১০৪.৩৩ মিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ কমেছে ৭১ শতাংশ। এসময় বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৭৬.৭৯ মিলিয়ন ডলারের। যা গেল অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ শতাংশ কম।
ব্যয়ের সাথে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, আর অধিক হারে মধ্যবিত্তের অবস্থান বিবেচনায় যেখানে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় এক বাজার হতে পারে সেখানে কেন এই অবস্থা? অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে নানামুখী নীতি প্রণয়ন হলেও তার ধারাবাহিকতা না থাকা, সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার অভাব, বিনিয়োগনীতি বারবার পরিবর্তন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অন্যতম। আর গেল কয়েক মাসে তীব্র হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এবং ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা খুব জরুরি একটা ব্যাপার। স্টেবল সরকার, স্টেবল পলিসি, স্টেবল ট্যাক্স স্ট্রাকচার খুব জরুরি। আমাদের দেশে বেশকিছু খুব ভালো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আছে, কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে তাদের অভারঅল এফডিআইয়ের যে কন্ট্রিবিউশন সে সংখ্যাটা যেহেতু কম, সে কারণে আসলে এফডিআই নিয়ে আমাদের যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খুব একটা বড় ধরনের উঠানামা হয় তা কিন্তু না।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হবে। এলডিসি গ্রাজুয়েশনে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থগিত করতে হবে। তারপর ব্যাংকিং যে সমস্যাগুলো আছে এগুলোর সমাধান করতে হবে। এনবিআরের পলিসিগত সাপোর্ট যেগুলো, সেগুলোকে পরিষ্কার করতে হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে জিরো টলারেন্সে আনতে হবে। এগুলো করা গেলে বিদেশি বিনিয়োগও আসবে, দেশি বিনিয়োগেও নতুন করে চিন্তাভাবনা হবে।
সম্প্রতি চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শুরু হওয়া বাণিজ্য যুদ্ধের সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। তবে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য খাতে সে সক্ষমতাও ক্ষীণ বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
আশরাফ আহমেদ বলেন, বিদেশিরা যেটা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় সেটা হলো নিয়মিত অ্যালিগেশন অব করাপশন থাকতে থাকে তখন তাদের জন্য এটা অপারেট করা খুব কঠিন হয়ে যায়। বাংলাদেশে কিন্তু আমাদের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আছে এফডিআই করার জন্য। এগুলো উৎরাতে না পারলে আমরা কিন্তু লং রানে এফডিআর আকর্ষণ করতে পারি না।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নানা রকমের সংকট রয়েছে। আমার এখানে গ্যাস সংকট, বিদ্যুৎ সংকট, ব্যাংকিং পলিসিগত সংকট রয়েছে, এনবিআরের নানারকম পলিসিগত সংকট রয়েছে। শ্রমিকের আনরেস্ট রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বলা চলে যে একেবারে নাজুক পরিস্থিতিতে। এগুলো দেখলে কিন্তু কোনো বিদেশি বিনিয়োগ কিন্তু এখানে আসবে না।
বৈদেশিক বিনিয়োগ কমলেও গেল ছয় মাসে বেড়েছে সামগ্রিক রপ্তানি। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.৬৮ শতাংশ বেশি। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ চিহ্নিত করে তা দ্রুত সমাধানের পরামর্শ তাদের।
অর্থনীতিবিদ ড. মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, বিদেশি মুদ্রা আনস্টেবল হয়ে গেছে আমাদের। বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে তাকান। মুদ্রাস্ফীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে বিদেশিরা এখানে বিনিয়োগ করার আসলে সুযোগই পাচ্ছে না। সুতরাং প্রথম পরামর্শ হলো একটা স্থিতিশীল সরকার আমাদের আসতে হবে। কোন কোন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ দরকার তার পলিসি ঠিক করার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বাড়তি উদ্যোগ নেয়া জরুরি।