এল আর বাদল : ভ্যাট বাড়ার আগে ৪২০ টাকা দিয়ে এক কেজি আনার কিনেছি। কিন্তু এখন সেটা দাম বেড়ে ৬০০ টাকা কেজি হয়ে গেছে। আমার যে আয়, তা দিয়ে ছেলেকে এত দাম দিয়ে আনার ফল কিনে খাওয়ানো সম্ভব নয়। বলছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ইমাম হোসেন।
গত ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর-মূসক (ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্র্বতী সরকার। অর্থবছরের (২০২৪-২৫) মাঝপথে এসে হঠাৎ করে এই ভ্যাট বৃদ্ধির শিকার হয়েছেন ইমাম হোসেন। সোমবার (২০ জানুয়ারি) রাজধানী ঢাকার গুলিস্তান এলাকায় তিনি বলছিলেন তার অভিজ্ঞতার কথা, সাম্প্রতিক ভ্যাট বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে তার সংসারেও। - ভয়েস অব আমেরিকা
ক্রেতার ওপর হঠাৎ যেমন বাড়তি ভ্যাটে চাপ বেড়েছে, তেমনি বিক্রেতারাও রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। ঢাকার সেগুনবাগিচার ফল বিক্রেতা আতিকুল ইসলাম জানান, দেশের বাইরে থেকে আসা ফলের দাম কেজিতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণে মানুষ এখন পরিমাণে কম কিনছে, যে কারণে বিক্রি কমে গেছে।
ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে জনজীবনে প্রভাব ফেললেও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র রক্ষার জন্য অর্থবছরের মাঝখানে এসে ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত ‘অবিবেচনাপ্রসূত’ এবং এতে করে বেকারত্ব বাড়বে, মানুষ আরও ঋণগ্রস্ত হবে। ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা এসেছে খোদ অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও জাতীয় নাগরিক কমিটির কাছ থেকেও।
ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে আলাপকালে অর্থনীতিসংশ্লিষ্টরা জানান, বছরের মাঝপথে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির মূল কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ।
২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে। ঋণের চতুর্থ কিস্তি এখনও ছাড় হয়নি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অর্থছাড়ের উদ্দেশ্যে ভ্যাট বৃদ্ধি করেছে সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের কারণে ইতোমধ্যে পোশাক, মিষ্টি, টিস্যু, এলপি গ্যাস, ওষুধ, ফলের রস, ড্রিংক, বিস্কুট, চশমার ফ্রেম, সিগারেটসহ নানা পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। পরে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রত্যাহার করা হলেও দাম আগের জায়গায় ফিরে আসেনি।
বুধবার (২২ জানুয়ারি) জারি করা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর অনুসারে রেস্তোরাঁ, ওষুধ, মোবাইল ফোন, আইএসপি সেবা, মোটরগাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপসহ বেশ কিছু পণ্যের ওপর থেকে বাড়তি মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, চিকিৎসা সেবা আরও সহজ করতে ওষুধ শিল্পের ওপর ব্যবসায়িক পর্যায়ে যে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করে আগের অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। অর্থাৎ এই খাতে এখন থেকে ২ দশমিক ৪ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে।
দাম বৃদ্ধি, কমে গেছে বিক্রি -
আমদানিকৃত ফলের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। যার ফলে বাজারে আমদানি করা ফলের কেজিতে সর্বনি¤œ ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণে ফল বিক্রিও কমে গেছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ইমাম হোসেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আগে একদম ভালো আপেলের কেজি ২৮০ টাকা ছিল। সেটার দাম এখন বেড়ে হয়েছে ৩৯০ টাকা। একইভাবে সব ধরনের ফলের দাম কেজিতে ১২০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এখন আমাদের মতো পরিবারের দেশি ফল, যেমন—কুল, পেঁপে, কলা ছাড়া অন্য কিছু খাওয়া সম্ভব নয়।
রাজধানীর একটি সুপারশপের বিক্রয়কর্মী তারিফুল ইসলাম। তিনি জানান, ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে তাদের আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের মধ্যে কিছু জিনিসের দাম বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণে গত কয়েক সপ্তাহের তুলনায় বিক্রিও কিছুটা কমেছে।
ওই সুপারশপ থেকে ভোজ্যতেল সয়াবিন ক্রয় করেছেন নাজিম উদ্দিন। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, আগে ৫ কেজি সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৫২০ টাকা। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৫৮৩ টাকা। একইভাবে অন্যান্য আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যের প্যাকেটে ১০-২০ টাকা করে বেড়েছে।
কর বাড়লেও জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়বে না: অর্থ উপদেষ্টা
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দাবি করেছেন, কর বাড়লেও জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়বে না। আমাদের মূল্যস্ফীতির মূল ইন্ডিকেটরগুলো হলো— চাল, ডাল এগুলো। আমরা যেসব জিনিসের ওপর কর বাড়াচ্ছি, এগুলো মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই, এমনকি নেপাল, ভুটানেও বাংলাদেশের মতো এত কম কর (ট্যাক্স) নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ক্ষেত্রে আমরা সব সময় বলেছি, সেখানে আমরা প্রায় জিরো কর-এ নিয়ে আসব।
অবিবেচনাপ্রসূতভাবে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে: দেবপ্রিয়
অবিবেচনাপ্রসূতভাবে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও সিটিজেনস প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজির আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে প্রত্যক্ষ করে মনোযোগ দেওয়া দরকার হলেও অন্তর্র্বতী সরকার আগের মতোই পরোক্ষ করে নজর দিচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোনো দেশে সরকার যদি কার্যকরভাবে কর আদায় করতে চায় তাহলে তাকে ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ করের দিকে নজর দিতে হবে। কিন্তু সরকারকে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো পরিকল্পনা দেখছি না। প্রত্যক্ষ কর বাদ দিয়ে প্রথমেই পরোক্ষ করের দিকে ঝুঁকছে সরকার। বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
বেকারত্ব ও মানুষ আরও ঋণগ্রস্ত হবে: মাহা মির্জা -
উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গীসহ বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যুক্ত, এমন প্রভাবশালীদের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে ইতোমধ্যে অনেক মানুষ বেকার হয়ে গেছে, কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এখন বাড়তি ভ্যাটের বোঝায় মানুষ আরও ঋণগ্রস্ত হবে, হারাবে কর্মসংস্থান।
তিনি বলেন, বেকারত্ব, আগের সরকারের ভ্যাট, মূল্যস্ফীতি—সবকিছু মিলিয়ে মানুষ এখনই অসম্ভব রকমের চাপের মধ্যে আছে। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। মানুষ যখন অতিরিক্ত চাপ ও ঋণগ্রস্ত হয়ে আছে, সেই সময়ে আশা করা হয়েছিল যে নতুন বাংলাদেশে, নতুন সরকার, নতুন কিছু হবে। যেখানে অনেক সংস্কারের কথা হচ্ছে, সেখানে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ভ্যাট বৃদ্ধির অধ্যাদেশ জারি করা প্রচ- মাত্রায় অগণতান্ত্রিক।
এমনিতেই দেশের অর্থনীতিতে একটা অচলাবস্থা চলছে, তার ওপর বাড়তি ভ্যাট ও করের ফলে উৎপাদক যদি উৎপাদন কমিয়ে দেয়, তখন মানুষ কর্মসংস্থান হারাবে। অন্যদিকে মানুষ যদি কেনাকাটা কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়, সেটা বাজারের জন্য ভালো নয়। অর্থনীতির গতি তো তখনই সঞ্চার হয়, যখন মানুষ কেনাকাটা করতে পারে। সেখানে ভ্যাট বাড়ানোর ফলে মানুষের যখন ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে, তখন সেটা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন মাহা মির্জা।
সরকারের রাজস্ব ঘাটতি প্রসঙ্গ টেনে মাহা মির্জা বলেন, আমাদের প্রত্যক্ষ কর বা রাজস্ব বাড়ানোর অনেক জায়গা আছে। আমি যতটুকু জানি রাজস্বের ৩০-৪০ শতাংশ আসে প্রত্যক্ষ কর থেকে। যেটা ভারতে ৫০ শতাংশের ওপর। অন্যান্য দেশে সেটা ৭০-৮০ শতাংশ।
রাষ্ট্রকে বাঁচাতে আমাদের এটা করতে হয়েছে: এনবিআর চেয়ারম্যান
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, একটা কথা আছে—প্রয়োজন কোনো আইন মানে না। এখন রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, রাষ্ট্রকে বাঁচানোর জন্য আমাদের এটা করতে হয়েছে। এটাই হচ্ছে মূল কথা।
আবদুর রহমান খান আরও বলেন, অর্থনীতিবিদরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবশ্যই সঠিক কথা বলছেন যে, বছরের মাঝখানে এটা করা ঠিক না। কিন্তু এখন আমাদের অনেক কিছু করতে হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র, অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিকে ঠিক রাখার জন্য।
ভ্যাটসংক্রান্ত মামলায় এনবিআরের মাঠে অনাদায়ি রাজস্ব ৫০ হাজার কোটি টাকা উদ্ধারে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান বলেন, এগুলো উদ্ধারে নানা পদক্ষেপ চলমান। এগুলো ট্রাইব্যুনাল, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ ও অ্যাটর্নি জেনারেল সবাই পর্যবেক্ষণে রাখছেন। তারা চেষ্টা করছেন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য।
আইএমএফের শর্ত পরিহারের উপায় ছিল না সরকারের: টিআইবি
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, আমি সাধারণভাবে যেটা বুঝি, দুইটা কারণে সরকার এটা করতে বাধ্য হয়েছে। প্রথমত, প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায়ে বিশাল ঘাটতি। দ্বিতীয়ত, আইএমএফের কাছ থেকে যে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তার শর্ত হিসেবে ভ্যাট বাড়িয়েছে। আইএমএফের শর্ত পরিহার করার কোনো উপায় ছিল না সরকারের কাছে।
ভবিষ্যতে (এই অর্থবছরের বাকি সময়ে) প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব ঘাটতি পূরণের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, এমনিতে বাংলাদেশে পরোক্ষ করের তুলনায় প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ খুবই কম। তারপর বছরের এই সময়ে প্রত্যক্ষ কর যেটুকু আদায় হওয়ার কথা এবং সামনে যে সময়টুকু বাকি আছে, তাতে তা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ প্রত্যক্ষ করের সবচেয়ে বড় উৎস যারা, তাদের অনেকে বিভিন্ন কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে দূরে আছে। আবার অনেকের বিরুদ্ধে মামলা আছে, অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ আছে, যেগুলো চলছে, সেগুলো স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এটা করতে বাধ্য হয়েছে বলে আমি মনে করি।”
ইফতেখারুজ্জামানের মতে সরকার যেটা বলছে যে, জনগণের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, দ্রব্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। এটা আসলে সরকারের উচ্চাভিলাষী বক্তব্য ছিল। কারণ এই ধরনের কর বা ভ্যাট যখন আরোপিত হয়, সেটার প্রভাব শুধু যে বস্তুর ওপর আরোপ হয় তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সার্বিকভাবে দ্রব্যমূল্য থেকে সব সেবার মধ্যে গিয়ে পড়ে এর প্রভাব। কাজেই ভ্যাট বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব নি¤œ-মধ্যবিত্তের ওপর গিয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
‘পণ্য ক্রয় বন্ধ ও শ্রমিকের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসবে’
বাংলাদেশে এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সূত্র থেকে বলা হয়েছে, গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে। সেখানে মেশিনে প্রস্তুতকৃত বিস্কুট, কেক, আচার, চাটনি, টমেটো তৈরি পণ্য, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প ইত্যাদি পণ্যের ওপর মূসক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলের রস ও ফ্রুট ড্রিংকসের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করেছে। ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক শূন্য থেকে বাড়িয়ে বর্তমানে তা ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ী পর্যায়ে আগে ৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপ ছিল; যা বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী জানান, প্রান্তিক কৃষকের আম, টমেটো, আনারস, কলাসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে জুস, ড্রিংকস, আচার, সস তৈরি করা হয়। এসব পণ্যের ওপর মূসক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক চাষিরা। ভ্যাট ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে যেসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, অনেকেই সেসব পণ্য ক্রয় বন্ধ করে দেবেন। এর প্রভাবে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে অসংখ্য শ্রমিকের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
ভ্যাট বৃদ্ধি নিয়ে কেন সেভাবে সরব নয় বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো?
সরকারের ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের পর এক সংবাদ সম্মেলন করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হলেও মাঠের কোনো কর্মসূচিতে যায়নি বিএনপি। শুধু বিএনপি নয়, কোনো রাজনৈতিক দলই তা প্রত্যাহারের দাবিতে এখন পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করেনি। দলগুলো বলছে, বর্তমান সরকার গণবিরোধী সরকার নয়। তারা জনগণের কষ্টকে বিবেচনায় নিয়ে বাড়তি ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করেছে। তা সমন্বয় করে নেবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনসমর্থিত ও আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সরকার বলে উল্লেখ করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, আমার বিশ্বাস, গণবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত হলে সরকার তা সংস্কার করে নেবে। জনগণের ইচ্ছার সাথে তাদের সিদ্ধান্তের সমন্বয় থাকবে। তাই যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে সরকার দ্রুত একটা কার্যকর সিদ্ধান্ত নেবে। যাতে জনগণের ওপর যে বাড়তি চাপ পড়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যে বাড়তি ভ্যাট আরোপ করেছে, তা প্রত্যাহার করে নেবে।
বিএনপির এই নেতার মতে, আইনগত সংস্কার দরকার আছে। যাতে (কোনো) সরকারই কা-জ্ঞানহীন ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধি করতে না পারে। রুহুল কবির রিজভী মনে করেন, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকারকে বিভিন্ন সংস্কারের জন্য চাপ দেয়। তাদের কথা শুনতে হয়। কারণ তারা ঋণ দেয়। সে ক্ষেত্রে কিছু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, যাতে কোনোভাবে জিনিসপত্রের দাম না বাড়ে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ যেন ঠিক থাকে, বাজারে কেউ যেন সিন্ডিকেট করতে না পারে। এ রকম কিছু পদক্ষেপ নিলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না বলে বিশ্বাস রুহুল কবির রিজভীর।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, যারা অত্যাচারী, অনির্বাচিত শাসক, জোর করে ক্ষমতায় আসে, তাদের সব কর্মকা-ের বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষোভ থাকে। কিন্তু এই সরকার ইচ্ছা করে ক্ষমতায় আসেনি, জনগণ তাদের নিয়ে এসেছে। তাদের কাজের ভুলত্রুটির সমালোচনা, প্রতিবাদ জামায়াত গণতান্ত্রিক পন্থায় করছে। যদি মনে হয় সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এসব দুর্বলতা দূর করছে না, স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে, তখন তারা (জামায়াত) বিক্ষোভ কিংবা প্রতিবাদের মাত্রা আরও বাড়াবে।
ভ্যাট নিয়ে মন্তব্য করতে চান না গভর্নর-
অর্থবছরের মাঝপথে ভ্যাট বৃদ্ধির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তিনি রিজার্ভ নিয়ে কথা বলেন।
আহসান এইচ মনসুর ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, আমাদের যে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল, চলতি হিসাবে ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল। সেটা এখন অনেকটাই নেই। নতুন করে আমাদের রিজার্ভের আর পতন হয়নি, বরং একটু বেড়েছে। আরও বেশি বাড়ানো দরকার।
গভর্নর বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারও অপরিবর্তিত রয়েছে। গত চার মাসে ২ টাকা পরিবর্তন হয়েছে। এই সূচকগুলোতে একটা স্থিতিশীলতা এসেছে। এখানে উন্নতির গতিও ভালো এবং আমরা সন্তুষ্ট।
চালের দামটা কিছুটা বাড়তি। এটা নিয়ে কিছু করার নেই। কারণ, চালের দাম বাংলাদেশের চাইতে বিশ্ববাজারে বেশি। এতে গ্রামের কৃষকরা কিছুটা লাভবান হবে।
আটকে থাকা রাজস্ব প্রশাসনিকভাবে দ্রুত আদায় করা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, তবে প্রশাসনিক প্রক্রিয়াতে অবশ্যই আমাদের যেতে হবে, কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
আপনার মতামত লিখুন :