মহসিন কবির: ভ্যাট বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়বে। আবার পোশাকের দামও বাড়তে পারে। এমন অবস্থায় ভ্যাট বাড়ানো আত্মঘাতী ডিসিসিআই। রাজনীতিবিদ ভ্যাট বাড়ানো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন।
সম্প্রতি শতাধিক পণ্যের ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী মহলই নয়, দেশের অর্থনীবিদরাও বিস্মিত। অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলাপ না করে এটি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হয়েছে। দেশের মানি মার্কেটে সংকট, ব্যাংকিং খাতে অস্বস্তি চলছে, এর ওপর ডলারের মূল্য বাড়ছে- সবকিছুর পরও এরকম একটি সিদ্ধান্ত বছরের মাঝামাঝি করা হয়, কিভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে সেটি বোধগম্য নয়।
শনিবার ঢাকা চেম্বার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সংগঠনটির নতুন সভাপতি তাসকিন আহমেদ। দেশের সমসাময়িক অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি এবং ২০২৫ সালে ডিসিসিআইর বর্ষব্যাপি কর্ম-পরিকল্পনা সম্পর্কে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
তাসকিন আহমেদ বলেছেন, এটি খুব দ্রুতই মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলবে। দেশের জনগণের ওপর এটির একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। আমরা এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে মোটেও একমত নই। এটি বেসরকারি খাতের ওপর পড়লে এটি আত্মঘাতী হবে। এটি শুধু ভ্যাট-ট্যাক্সই নয়, একদিকে সুদের হার বেড়ে গেছে, মুদ্রাবাজার অস্থির, এছাড়া করের হার বাড়িয়ে দিলে শুধু বিদেশি বিনিয়োগকারীই নয়, স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এর ফলে দেশের অর্থনীতি ধীর হয়ে যাবে, এর পুরো খরচা ভোক্তাদের ওপর পড়বে।
ডিসিসিআই বলছে, সিএমএসএমই খাতে ৯০ শতাংশ বিনিয়োগ আসে বেসরকারি ব্যাংক থেকে। তবে এখাতের উদ্যোক্তারা উচ্চ সুদহার, বাজারের সঠিক তথ্যের অভাব ও প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাবে বিনিয়োগ পাচ্ছে না। তাদেরকে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে চায় না।
হঠাৎ গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এ সুপারিশে আমরা উদ্বিগ্ন। আমাদের হাতে কোনো ম্যাজিক নেই যে আমরা এটি দিয়ে চলতে পারবো। এর আগে ৪০০ শতাংশ গ্যাসের দাম বাড়ানোয় হুমকির মুখে পড়েছে এ খাত। তাছাড়া চাহিদার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে, এদিয়েই আমাদের চলতে কষ্ট হচ্ছে।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দেশ চালানোর কথা ভাবলে লড়াই বাধবে বলে মন্তব্য করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।শনিবার (১১ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে তিনি একথা বলেন। টিসিবির ট্রাক সেল বন্ধ, ৪৩ লাখ পরিবারের কার্ড বাতিল এবং শতাধিক পণ্যে শুল্ককর বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এই মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়।
মান্না বলেন, আইএমএফ বাংলাদেশকে ৬৪০ কোটি ডলার বা ৬৭০ কোটি ডলার দেবে। টাকা দেওয়ার বদলে তারা ১০০টা দ্রব্যের ওপরে ভ্যাট ট্যাক্স বাড়াতে বলেছে। আপনি ভালো লোক। আপনি আরও ভালো থাকেন। আমরা আপনাকে তো অসম্মান করছি না। কিন্তু আমার পেটে যদি ক্ষুধার আগুন জ্বলে তাহলে আমি বলব, আপনি এ সমস্ত ট্যাক্স কেন তুলে দিয়েছেন? কাজের কাজ এখনো কী করতে পেরেছেন? ব্যাংকগুলো সব ঠিকমতো চলে? যেরকম চেক দেয়, সেরকম টাকা দিতে পারে? এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো তার নিয়ম অনুযায়ী চলে? সবগুলো ব্যাংকে যথাযথ তারল্য আছে?
যে সকল পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে এর মধ্যে নিত্যপণ্য না থাকায় মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ৪ জানুয়ারি সংস্থাটির এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এনবিআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মূল্য সংযোজন করের পাশাপাশি আয়করের ক্ষেত্রেও করের আওতা বৃদ্ধির নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। আয়কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার ধারাবাহিকতায় আয়কর অব্যাহতির বিধান বাতিল ও সংশোধনের কার্যক্রম ও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যে সকল পন্য ও সেবায় ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করা হচ্ছে তার মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য নেই বিধায় সর্বসাধারণের ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে না এবং মূল্যস্ফিতিতে প্রভাব পড়বে না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের জেরে দীর্ঘ সময় ধরে ভুগছে শিল্প খাত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের প্রত্যাশা ছিল ব্যবসায় গতি ফিরবে। কিন্তু আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ, চাঁদাবাজি, মালিকানা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাসহ নানা রকম অস্থিরতা বিরাজ করে। এতে আরও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় ব্যবসায়ীদের। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা ছিল- ব্যবসা-সহায়ক নীতি গ্রহণ করবে অন্তর্বর্তী সরকার। অথচ একের পর এক চাপে পিষ্টপ্রায় ব্যবসা-বাণিজ্য।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু গণমাধ্যমকে বলেছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া ব্যবসার পরিবেশ তৈরি হবে না। দেশের মানুষ এখনও জানে না রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা এখন নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছেন। নির্বাচন যখনই হোক না কেন, তার একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা থাকা দরকার বলে মনে করছেন তিনি।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম গণমাধ্যমকে বলেছেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সাধারণ ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। দেশের স্বার্থেই ব্যবসায়ীদের হয়রানি মুক্ত রাখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ব্যবসায় নতুন করে চাপ বাড়ছে জানিয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর ফলে উৎপাদন খাতের টিকে থাকা আরও কঠিন হবে। দেশের তরুণরা কর্মসংস্থানের জন্যই আন্দোলন করেছে। এখন প্রয়োজন শিল্পের বিকাশ, যাতে কর্মসংস্থান বাড়ে। অথচ যেসব নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে, সেগুলো এর বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে উল্টো কমবে। তিনি আরও বলেন, আইএমএফের দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে শিল্প খাতের ক্ষতি করা যাবে না। ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোয় শিল্পের উৎপাদন কমবে। যার প্রভাব পণ্যমূল্যে পড়বে। অপরদিকে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেটা হলে কোনো অবস্থাতেই শিল্প খাত প্রতিযোগিতামূলক হবে না। পণ্য উৎপাদন ব্যয় যদি প্রতিযোগিতামূলক না হয়, তাহলে তো শিল্প-কারখানা করে লাভ নেই।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল গণমাধ্যমকে বলেছেন, ব্যবসায় গতি আনতে ব্যবসাবান্ধব নীতি ও পরিবেশ প্রয়োজন, যাতে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলে। কিন্তু বর্তমানে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি, ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোয় ব্যবসা আরও চাপে পড়বে। ব্যবসায় স্বাভাবিক গতি না থাকলে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করা হবে কার কাছ থেকে? তাই আগে ব্যবসা সচলের পথ সুগম করতে হবে। তাহলে রাজস্ব আয় এমনিতেই বাড়বে।