বণিক বার্তা প্রতিবেদন: দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হতে পারে আগামী বছরের মার্চে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট (১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার) নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান রোসাটম। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নকশাসহ বিভিন্ন মানদণ্ড পূরণ সাপেক্ষে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হওয়ামাত্রই কেন্দ্রটি উৎপাদনে নেয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়লে বড় এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে যাওয়ার পর বৃহৎ সক্ষমতার অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বসিয়ে রাখতে হতে পারে। এমনকি দেশের কয়লাভিত্তিক বড় প্রকল্পগুলোয়ও উৎপাদন বন্ধ রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
রূপপুর উৎপাদনে আসার পর দেশের মোট বিদ্যুৎ সক্ষমতার বড় একটি অংশের প্রয়োজন তেমন একটা থাকবে না। এজন্য বেশকিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে হয় অলস বসিয়ে রাখতে হবে, নয় অবসরে পাঠাতে হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো ব্যয় বিবেচনায় শুরুতে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে অবসরে পাঠানো হবে। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে গ্রিড ব্যবস্থায় পূর্ণ সক্ষমতায় চালু রাখতে হবে। কারণ রূপপুর উৎপাদনে আসার পর সেখান থেকে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের তরঙ্গকে গ্রিডে বেইজলোড (সার্বক্ষণিক চালু রাখতে হয় এমন) কেন্দ্রগুলো থেকে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের তরঙ্গের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এক্ষেত্রে বেইজলোড কেন্দ্রগুলোর মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের প্রাধান্যই বেশি।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপিডিবি সাধারণত উৎপাদনে সবচেয়ে কম খরচের বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বিবেচনায় নেয়। সে অনুযায়ী রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের খরচ যদি কম হয়, সেক্ষেত্রে হয়তো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখতে হতে পারে। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকেও কিছু মাত্রায় চালু রাখার প্রয়োজন পড়তে পারে। যদিও এগুলোর পুরো সক্ষমতার জন্যই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে বিপিডিবিকে। এজন্য সংস্থাটির বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ খরচ কমার সুযোগ তেমন একটা নেই। সংস্থাটির এখন ব্যয় কমানোয় সবচেয়ে বেশি জোর দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এর পরিবর্তে রূপপুরের মতো কেন্দ্রকে তড়িঘড়ি করে গ্রিডে যুক্ত করে বিপিডিবির খরচের বোঝা আরো বাড়ানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মার্চের পর রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টেস্টিং-কমিশনিং শুরুর কথা রয়েছে। বড় এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর আগে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হচ্ছে। আমরা তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন (রূপপুর কর্তৃপক্ষ) নিয়ে কোনো প্রজেকশন এখনো পাইনি। এ-সংক্রান্ত বিষয়গুলো আমরা তাদের কাছে জানতে চাইব। এরপর আমরা বুঝতে পারব ঠিক কতটুকু ও কী পরিমাণ বিদ্যুৎ আমাদের গ্রিড ব্যবস্থায় সরবরাহ করতে পারব। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এখনো বিপিডিবি তাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রক্ষেপণ পায়নি। সেখান থেকে এ ধরনের বিষয়গুলো পাওয়ার পর আমরা তাদের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে যাব।’
রূপপুর উৎপাদনে গেলে দেশের বড় সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখতে হবে কিনা জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘বেইজলোডভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখার কোনো পরিকল্পনা নেই। কারণ রূপপুর চালু হলে লোড ম্যানেজমেন্টের জন্য বেইজলোড বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রেখে গ্রিডে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। বরং রূপপুর চালু হলে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে কীভাবে উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে পর্যায়ক্রমে অবসরে পাঠানো যায়, সেই পরিকল্পনা করবে বিপিডিবি। কারণ এগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।’
দেশে বিদ্যুতের মোট স্থাপিত সক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৪০ মেগাওয়াট। রূপপুরের প্রথম ইউনিট গ্রিডে যুক্ত হলে তা দাঁড়াবে ২৮ হাজার ৯৪০ মেগাওয়াটে। এখন পর্যন্ত দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার রেকর্ড ১৬ হাজার ৪৩৫ মেগাওয়াট। শীতে তা নেমে যায় সাড়ে ৯ হাজার থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াটে। চাহিদা নেমে আসায় বর্তমানে দেশে মোট বিদ্যুৎ সক্ষমতার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। যদিও খাতসংশ্লিষ্টদের হিসাবে, বেইজলোডভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা দিয়েই দেশে বিদ্যুতের শীতকালীন চাহিদা পূরণ সম্ভব। সেক্ষেত্রে গ্যাস, জ্বালানি তেল ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক এবং ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটাই বসিয়ে রাখতে হয়।
বিপিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট দুই কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি আমদানি সংকট এবং সর্বনিম্ন ব্যয় বিবেচনায় নেয়া হলে রূপপুর উৎপাদনে এলে বেইজলোডভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হতে পারে। কারণ বিদ্যুতে সক্ষমতা তৈরি হলেও সামনের দিনগুলোয় যদি অর্থ পরিশোধ ও ডলারের সংস্থান নিয়ে জটিলতা বাড়ে, সেক্ষেত্রে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে চালু করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগী হবে বিপিডিবি।’
এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির ৬২ শতাংশই আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে এসব কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি ব্যয় মেটাতে না পারায় অনেকগুলো কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জ্বালানি ব্যয় ও খরচ বিবেচনায় জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতার প্রায় ৮০ শতাংশই উৎপাদনে ছিল না।
বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ১২ হাজার ৩৩৩ মেগাওয়াট। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রের সক্ষমতা ৫ হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট। আর ভারত থেকে জিটুজি চুক্তির ভিত্তিতে আমদানি হচ্ছে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট, সৌর বিদ্যুতের সক্ষমতা রয়েছে ৬০৩ মেগাওয়াট এবং জল ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৯০ মেগাওয়াট।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, দেশে বিদ্যুতের চাহিদা উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় অনেক কম। জ্বালানি সংকটে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে সবসময় বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। যদিও মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকই কয়লাভিত্তিক। এছাড়া গ্যাস সংকটের কারণে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বেশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না। বড় তিনটি গ্যাসভিত্তিক বেইজলোডভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রেশনিং করে চালাতে হচ্ছে বিপিডিবিকে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ১ হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় আমাদের সক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি। এ সক্ষমতা আমরা ব্যবহার করতে পারছি না। সেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো উচ্চ সক্ষমতার কেন্দ্র দ্রুত উৎপাদন সিস্টেমে যুক্ত করার মাধ্যমে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। দেশের বেইজলোডভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না, অন্যদিকে বকেয়া পরিশোধ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। সেখানে নতুন করে রূপপুরের মতো কেন্দ্র উৎপাদনে এনে খরচের খাত তৈরি করা হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বিবেচনায় সবচেয়ে সাশ্রয়ী পন্থা নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এটি করার কোনো পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। তাহলে বোঝা যাবে কতগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালিয়ে বিপিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে পারবে এবং একই সঙ্গে উৎপাদন খরচও কমাতে পারবে। সেখানে অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতাকে যুক্ত করে আর্থিক ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে।’
দেশে এবারই প্রথম উৎপাদনে আসছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু এবং তা গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা কারিগরিভাবে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র একবার বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করলে তা সরবরাহ ব্যবস্থায় অন্তত ছয়-সাত মাস সার্বক্ষণিক সংযুক্ত রাখার মাধ্যমে গোটা সরবরাহ ব্যবস্থায় ভারসাম্য ধরে রাখতে হয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট গ্রিডে যুক্ত হওয়ার অর্থ হলো বিদ্যুতে উৎপাদন সক্ষমতা আরো ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বেড়ে গেল। এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হবে। সেক্ষেত্রে অন্য কেন্দ্রের সঙ্গে লোডের ভারসাম্য আনতে হবে। রূপপুরের এ কেন্দ্র চালু হলে গ্রিডে মোট সক্ষমতার ১০ শতাংশ অতিরিক্ত প্রস্তুত রাখতে হবে। কোনো কারণে একটি সক্ষমতা গ্রিড থেকে আউট হয়ে গেলে যাতে এ সক্ষমতা গ্রিডে পূরণ করে দেয়া যায়।’
রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় রূপপুরে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটিতে উৎপাদন ইউনিট দুটি। প্রতিটির সক্ষমতা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চলতি ডিসেম্বরে চালু হওয়ার কথা ছিল। তবে সরকার তা আগামী বছরের মার্চে চালুর পরিকল্পনা করছে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। রোসাটমের দাবি, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ চাহিদার অন্তত ১০ শতাংশ পূরণ করবে প্রকল্পটি।
আপনার মতামত লিখুন :