রাজধানীসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে নারী পাচারকারী চক্রের ভয়ংকর সিন্ডিকেট। নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে গড়া চক্রের সদস্যরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে সহজ-সরল কিশোরী ও তরুণীদের উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দিয়ে, কিংবা বিয়ে বা প্রেমের ফাঁদে ফেলে ঢাকায় নিয়ে আসে। এর পর এই নারী পাচারকারীরা নিজে ভোগ করার পাশাপাশি দালাল চক্রের মাধ্যমে এসব ভুক্তভোগীকে বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে বিক্রি করে দেয়। সেখানে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করা হয়।
জানা গেছে, ভাড়াটে স্বামী সাজিয়ে বিদেশে পাচার করে দেহব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে অসংখ্য তরুণীকে। অর্থের নেশায় উচ্চ শিক্ষিত তরুণরাও এই সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়ছে, বিশেষত ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে। এসব মাধ্যম ব্যবহার করে কিশোরী-তরুণীদের ঢাকায় এনে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে তাদের বন্দিজীবন কাটাতে হচ্ছে। চক্রের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি চায় এসব ভুক্তভোগী।
এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার ঢাকার মানবপাচার অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছে মানবাধিকার সংগঠন এইচআরএইচএফ (হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশন)। সংগঠনটির সদস্য মো. শহিদুল ইসলাম রাজু বাদী হয়ে ঢাকার ১০টি আবাসিক হোটেলের মালিক, কর্মকর্তা ও দালালসহ ৩১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। এর আগে ৮ এপ্রিল নারী পাচারকারীদের জিম্মিদশা থেকে ৯ তরুণীকে উদ্ধারের জন্য প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্তরা নারী পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য এবং তারা গ্রামে সহজ-সরল কিশোরী ও তরুণীদের প্রলোভন দিয়ে বিদেশে ভালো কাজের নাম দিয়ে, তাদের অর্থ ও স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয় এবং পরে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এই নারী পাচারকারীরা তাদের ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তাদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে।
বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়ে এইচআরএইচএফের সদস্যরা ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলগুলোতে গিয়ে সেখানে কিশোরী-তরুণীদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হতে দেখেছেন। রোজউড, সিগাল, রাজমনি, হোটেল প্রাইম ইন, হোটেল গ্রীন গার্ডেন, হোটেল ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, উত্তরা সিটি গেস্ট হাউস, হোটেল ওয়ান স্টারে এসব অপকর্ম হচ্ছে বলে জানায় সংগঠনটি। ৭ তরুণীর নাম উল্লেখ করে, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী এসব হোটেলের ব্যবসায়ীরা ও দালালরা কীভাবে তাদের জিম্মি করে রেখেছে, তা বিস্তারিতভাবে জানানো হয়।
ভুক্তভোগীরা জানায়, প্রতিটি আবাসিক হোটেলে ২০-২৫ জন তরুণীকে জিম্মি করে রাখা হয়। তাদের সঙ্গে অস্বীকৃতি জানালে মারধরের হুমকি দেওয়া হয় এবং অনেক সময় বিদেশে পাচার করার ভয় দেখানো হয়। মারিয়া ও আছিয়া (ছদ্মনাম) নামের দুই তরুণীকে চাকরি দেওয়ার নাম করে ২৬ মার্চ মামলার এক নম্বর আসামি মো. মিজান এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবের দাম্মামে পাচার করা হয়। পরে তারা জানায় যে সেখানে তারা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের ফিরিয়ে আনতে ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করেছে চক্রের সদস্যরা। এ বিষয়ে গত ২৭ এপ্রিল উত্তরা-পশ্চিম থানায় মামলা করতে গেলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা গ্রহণ না করে কোর্টে মামলা করার পরামর্শ দেন।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী জাকির হোসাইন গতকাল বুধবার দৈনিক আমাদের সময়কে বলেন, নারী পাচারকারীদের জিম্মিদশা থেকে অসংখ্য কিশোরী-তরুণীকে উদ্ধারের জন্য মানবাধিকার সংগঠন এইচআরএইচএফের পক্ষ থেকে আদালতে গত মঙ্গলবার একটি মামলা হয়েছে। আদালত মামলাটি উত্তরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
এ ছাড়া, এই চক্রের সদস্যরা ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে দেহব্যবসায় জড়িত নারীদের শরীরের প্রতি অত্যাচার ও শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে; এমনকি তাদেরকে মাদক সেবন এবং জুয়া খেলার আসরে থাকতে বাধ্য করছে। পুলিশকে ম্যানেজ করেই চলছে এসব অপকর্ম। এইচআরএইচএফের পক্ষ থেকে জিম্মি নারীদের উদ্ধারের জন্য মানবাধিকারকর্মীরা সরকারের কাছে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সূত্র: দৈনিক আমাদেরসময়