শিরোনাম
◈ ব্রাজিলকে হারিয়ে বাংলাদেশকে যে বার্তা দিলেন আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডার এনজো! ◈ ‘হিজাব মোড়ানো’ আইফেল টাওয়ার, বিজ্ঞাপন ঘিরে উত্তাল ফ্রান্স ◈ দেশের স্বার্থেই চলতি বছরের মধ্যে নির্বাচন চায় বিএনপি: মির্জা ফখরুল ◈ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে এখনো বিতর্ক কেন? ◈ জাতীয় স্মৃতিসৌধে জাতির বীর সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা  ◈ আজকে স্বাধীনতা দিবস প্রমাণ করে, দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে বাংলাদেশে কিছু নাই : মির্জা আব্বাস  ◈ স্বাধীনতা দিবসে যে হুঁশিয়ারি দিলেন নাহিদ ইসলাম (ভিডিও) ◈ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ব্রাজিলকে ৪-১ গোলে হারালো আর্জেন্টিনা  ◈ ফিল সিমন্স ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের হেড কোচ থাকছেন, চুক্তি সম্পন্ন ◈ অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহাসিক গাব্বা স্টেডিয়াম ভেঙে ফেলা হবে 

প্রকাশিত : ২৫ মার্চ, ২০২৫, ১১:০৩ দুপুর
আপডেট : ২৬ মার্চ, ২০২৫, ১১:৫৪ দুপুর

প্রতিবেদক : এল আর বাদল

মুখ বদলালেও চাঁদাবাজি থামেনি পরিবহনে, ঢাকাতেই দিনে আদায় দুই কোটির বেশি

এল আর বাদল : সোমবার (২৪ মার্চ) সকাল দশটা। ঈদের আগে ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে একের পর এক যাত্রীবাহী বাস। তবে টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার আগে দূর পাল্লার বাসগুলোর প্রতিটিকে চাঁদা হিসেবে গুনতে হচ্ছে ৫২০ টাকা।

এডিরে কয় জিপি (গেট পাস বা ছাড়পত্র)। জিপি না দিলে গাড়িই বাইরাতে পারবো না। যাত্রী থাউক, না থাউক, জিপি আমাগো দেওনই লাগে, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ময়মনসিংহগামী বাসের একজন চালক। ঘটনাটি যখন ঘটছিলো, তখন সেখানেই উপস্থিত ছিলো বিবিসি বাংলা। যিনি চাঁদার টাকা তুলছিলেন, কথা হয় তার সঙ্গেও। কেন এবং কার নির্দেশে চাঁদা তুলছেন? প্রশ্ন ছিল চাঁদা আদায়কারী ব্যক্তির কাছে। সূত্র, বিবিসি বাংলা

এইডাই এখানকার সিস্টেম। গাড়ি ছাড়ার আগে এই টাকা দিতে হয়। মালিক সমিতির নির্দেশেই এইডা তোলা হয়, বিবিসি বাংলাকে বলেন চাঁদা আদায়কারী ব্যক্তি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাঁচই অগাস্টের পটপরিবর্তনের পর লোক বদলালেও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি বাংলাদেশের পরিবহনখাতে।

মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন, রাজনৈতিক দলের নেতা এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে সারা দেশে এখনও প্রতিদিন আদায় করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল ঢাকা শহরেই বিভিন্ন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে দৈনিক গড়ে দুই কোটি টাকার ওপরে চাঁদাবাজি হচ্ছে বলে জানতে পেরেছে বিবিসি।

যার প্রভাব পড়ছে পরিবহনের ভাড়া ও সেবার মানের ওপর, বিবিসি বাংলাকে বলেন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ দেড় দশকের একটানা শাসনামলে দলটির নেতারা একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে পরিবহনখাতের চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব নিয়ন্ত্রণ করতো বলে অভিযোগ রয়েছে।

গণ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সেই স্থান দখল করেছে বিএনপিপন্থী মালিক ও শ্রমিকরা। ফলে বর্তমান চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের সঙ্গে এখন তারাই জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
যদিও পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের বর্তমান নেতারা অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো দাবি করেছেন যে, চাঁদা নয়; বরং সংগঠন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় খরচের অর্থই নিচ্ছেন তারা।

এদিকে, সংগঠনগুলোর বাইরে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যেও অনেকের নামে পরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। সরকার বলছে, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
আমরা ইতোমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে বসেছি...পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। বিআরটিএও কঠোর হচ্ছে, বিবিসি বাংলাকে বলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান।

মালিক সংগঠনের কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার পরিবহনের লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলেও জানিয়েছেন উপদেষ্টা।

নেতৃত্বে পালাবদল

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার কিছু দিনের মধ্যেই বাংলাদেশের পরিবহনখাতের শীর্ষ নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। গত ১৫ বছর ধরে দেশটির পরিবহনখাত নিয়ন্ত্রিত হতো মূলত মালিক ও শ্রমিকদের তিনটি সংগঠনের মাধ্যমে।

সেগুলো হলো: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এগুলোর মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশের মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।

মি. উল্লাহ টানা চারবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব পদে ছিলেন। এর মধ্যে তিন দফায় তার সঙ্গে সভাপতি হিসেবে ছিলেন জাতীয় পার্টির নেতা মসিউর রহমান। পাঁচই অগাস্টের পর থেকে মি. রহমানকে সেভাবে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। অনেকেরই ধারণা তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।

অন্যদিকে, জুলাই গণ অভ্যুত্থানের আগেই দেশ ছেড়েছেন মি. উল্লাহ। শেখ হাসিনার পতনের পর তিনিও আর দেশে ফেরেননি। এ অবস্থায় ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপিপন্থী পরিবহন নেতারা।

এরপর মালিকদের জরুরি সভায় সমিতির সভাপতি নির্বাচিত করা হয় ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হাজী আলাউদ্দিনকে। আর মহাসচিব পদে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর স্থলাভিসিক্ত হন কুমিল্লা উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম।

মি. ইসলাম সম্প্রতি ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিরও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তার সঙ্গে নতুন সভাপতি হয়েছেন বিএনপিপন্থী নেতা এমএ বাতেন।

একইভাবে, পরিবহন শ্রমিকদের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনে’র নেতৃত্বেও বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।

এই ফেডারেশনের অধীনেই রয়েছে দেশটির প্রায় আড়াইশ নিবন্ধিত পরিবহন শ্রমিক সংগঠন। আওয়ামী লীগ শাসনামলের বেশিরভাগ সময় জুড়েই সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। একাধিক মামলায় আসামি হয়ে মি. খান এখন কারাগারে রয়েছেন।

তার জায়গায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপিপন্থী আব্দুর রহিম বক্স। এছাড়া সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পদে ওসমান আলীর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন আরেক বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির খান।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মি. খান লিখেছেন যে, তিনি বিএনপি’র শ্রম বিষয়ক সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

একইভাবে, বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক এবং শ্রমিকদের সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বেও রদবদল হয়ে এখন বিএনপিপন্থীদের আধিপত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

পাঁচই অগাস্টের আগে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগপন্থী শ্রমিক নেতা তালুকদার মোহাম্মদ মনির। সরকার পতনের পর হত্যা মামলার আসামি হয়ে তিনি এখন কারাগারে আছেন।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম পাটোয়ারীও গত সাত মাস ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ অবস্থায় সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি বশির হাওলাদার। অন্যদিকে, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন মোহাম্মদ আলমগীর। তারা দু’জনই বিএনপিপন্থী নেতা বলে সংগঠনের সদস্যরা জানিয়েছেন।

চাঁদা আদায় হচ্ছে যেভাবে

ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় অবস্থিত ট্রাক স্ট্যান্ডেও প্রতিটি গাড়ি থেকে ১৪০ টাকা করে চাঁদা নিতে দেখেছে বিবিসি বাংলা। আদায়কৃত চাঁদার মধ্যে টার্মিনাল মাঠের নির্মাণ ও উন্নয়ন ফি বাবদ ১০০ টাকা করে নিচ্ছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতি।

এর বাইরে, শ্রমিক কল্যাণের নামে গাড়িপ্রতি ২০ টাকা নিচ্ছে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়ন।
এছাড়া স্ট্যান্ডের নিরাপত্তা প্রহরীদের বেতন বাবদ নেওয়া হচ্ছে আরও ২০ টাকা।

এভাবে স্ট্যান্ডটি থেকে প্রতিদিন গড়ে চারশ’ গাড়ি থেকে চাঁদা নেওয়া হয় বলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে, ঢাকার মহাখালী, গাবতলী এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে যে, সেখানে গাড়ি ঢোকানো এবং বের করা, উভয়ক্ষেত্রে চাঁদা দিতে হচ্ছে।

এর মধ্যে মহাখালী টার্মিনালে গাড়ি ঢোকানোর সময় বাসচালকদের কাছ থেকে ১১০ টাকা করে নিতে দেখেছে বিবিসি বাংলা।

এর মধ্যে ৪০ টাকা সিটি কর্পোরেশনের, ২০ টাকা ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির, কমিউনিটি পুলিশের ২০ টাকা, টার্মিনাল মসজিদের ২০ টাকা এবং ১০ টাকা বুকিং মাস্টারের, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন চাঁদার অর্থ আদায়কারী শহিদুল ইসলাম। তিনি অবশ্য কোনো ধরনের রশিদ ছাড়াই টাকা আদায় করছিলেন।

পরিচয় জানতে চাইলে মি. ইসলাম বলেন, আমি কমিউনিটি পুলিশ হিসেবে কাজ করছি। কর্তৃপক্ষই আমাকে এই (টাকা তোলার) দায়িত্ব দিয়েছে। একইভাবে, টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার সময় দূরপাল্লার পরিবহনগুলোকে ছাড়পত্র (জিপি) বাবদ ৫২০ টাকা করে চাঁদা দিতে দেখা গেছে।

মহাখালী টার্মিনালে প্রতিদিন গড়ে আটশ’র মতো পরিবহন ঢোকে এবং বের হয় বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ঢাকার গাবতলী ও সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকেও মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে প্রতিদিন মোটা অঙ্কের টাকা তোলা হয়।
আবার গাড়িগুলো যখন জেলা পর্যায়ের টার্মিনালে পৌঁছায়, সেখানেও আলাদাভাবে চাঁদা দিতে হয় বলে জানা যাচ্ছে।
যেমন ধরেন, ময়মনসিংহে গিয়েও সেখানকার টার্মিনালে আরও ১৭০ টাকা চাঁদা দিতে হয়, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ওই রুটের একজন বাস চালক।

বাস মালিকদের বড় দুই সংগঠন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সম্মতিতেই চাঁদার হার নির্ধারণ হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা।

এর বাইরে, যেকোনো রুটে নতুন বাস নামানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সড়ক মালিক সমিতিকে এককালীন মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এরকম চাঁদা জেলা বা স্থানীয় মালিক সমিতিকেও দিতে হয়।

চাঁদা তোলা হয় কত?

পরিবহনখাতে কী পরিমাণ চাঁদাবাজি হয়, সেটার একটি ধারণা পাওয়া যায় দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে।

গত বছরের মার্চে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে শুধুমাত্র ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে প্রায় এক হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়। তবে বাস্তবে যে চাঁদাবাজির পরিমাণ আরও বেশি, গবেষণায় সেটাও উল্লেখ করেন তারা।

অন্যদিকে, গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে, কেবল ঢাকা শহরের অবস্থিত অর্ধশতাধিক পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হয়।

মাস শেষে সেই চাঁদার টাকার পরিমাণ ৬৬ কোটি থেকে বেড়ে মাঝে মধ্যে ৮০ কোটি পর্যন্ত পৌঁছায় বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কারা এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত, সে ব্যাপারে টিআইবি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, মালিক-শ্রমিক সংগঠন, রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধিরা পরিবহনখাতের চাঁদার ভাগ পান।
গবেষণায় এটাও উঠে এসেছিল যে, দেশের বড় বাস কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রায় ৯২ শতাংশের পরিচালনার সঙ্গেই রাজনীতিবিদরা সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ রাজনীতিবিদই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত।

তবে পাঁচই অগাস্টের পর পরিবহনে চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে পুলিশের অংশগ্রহণ একেবারে কমে গেছে বলে গোয়েন্দাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে চাঁদাবাজির টাকা এখন মূলত পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং চাঁদা আদায়কারী ব্যক্তিদের মধ্যে ভাগ হচ্ছে তদন্তে উঠে এসেছে।

টার্মিনালগুলোর বাইরে ঢাকায় ৩৭টি লেগুনা স্ট্যান্ড, চারটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, তিনটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং একটি মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড রয়েছে। এসব জায়গায় থেকে চাঁদা আদায়ের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে জানা যাচ্ছে।

কারওয়ান বাজারে মালামাল নিয়ে আসা গাড়িগুলো থেকেও নেওয়া হয় চাঁদা। বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ বেশি বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিতে গিয়েও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আগে খায়তো আওয়ামী লীগ, এখন খায় বিএনপি, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কারওয়ান বাজারে পেঁয়াজ নিয়ে আসা ট্রাক চালক আব্দুল হান্নান। বাজারটিতে আসা ট্রাকগুলোকে দুইশ’ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় বলে জানিয়েছেন চালক ও ব্যবসায়ীরা।

অভিযুক্তরা কী বলছেন?

মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলো চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করছে। সেই সঙ্গে দাবি করেছেন, চাঁদাবাজি ছিল আওয়ামী লীগ আমলে। তখন সমিতির নামে চাঁদাবাজি উঠাইতো বিভিন্ন জায়গায়। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পরে সেটা বন্ধ করে দিয়েছি। আমরা ঘোষণা করে দিছি যে, ঢাকা পরিবহন সমিতির নামে কোনো চাঁদা ওঠানো যাবে না, বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি এমএ বাতেন।

তাহলে টার্মিনালগুলোতে বাস থেকে যে টাকা আদায় করা হচ্ছে, সেগুলো কী?

যেটা দেখছেন, সেটা চাঁদা না। সেটা হলো পরিচালনা ব্যয়। অফিসভাড়া, বেতন, টিকেট, কর্মচারী ইত্যাদি খরচের জন্য কোম্পানিগুলো এটা তোলে, বলেন মি. বাতেন।

আওয়ামী লীগ আমলে যেখানে দেড়-দুই হাজার টাকা করে নেওয়া হতো, আমরা এখন সেটা ৩০০-৩৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছি, বলেন এই বাস মালিক নেতা।

যদিও টার্মিনালভেদে অনেক সময় চাঁদার অঙ্ক কিছুটা কম-বেশি হয় বলে জানিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে গাড়ির সংখ্যা, স্টাফ ইত্যাদি হিসাব করে এটা নির্ধারণ করা হয়,” বলেন মি. বাতেন। ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতিও একই কথা বলছে।

ট্রাক স্ট্যান্ডের উন্নয়ন কাজে যে খরচ হয়েছে, সেটার জন্যই একশ টাকা করে নেওয়া হয়। বাকিটা সংগঠনের কাজে ও শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়, বিবিসি বাংলাকে বলেন বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি তোফায়েল হোসেন মজুমদার।

বিএনপি কী বলছে?

দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির যেসব অভিযোগ উঠছে, সেটি অবশ্য স্বীকার করছে বিএনপি। অভিযোগ পেলে সেগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলটির সিনিয়র নেতারা।

অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে আমরা সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থাও নিচ্ছি। মামলা করে আমরা অভিযুক্তদেরকে পুলিশের হাতে পর্যন্ত তুলে দিচ্ছি, বিবিসি বাংলাকে বলেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

পাঁচই অগাস্টের পর দলটির বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও বিষয় নিয়ে একাধিকবার কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করতে দেখা গেছে। তারপরও যারা দলীয় নির্দেশনা মানছেন না, তাদের বহিষ্কার করতে দেখা গেছে।

বিএনপির তথ্যমতে, পাঁচই অগাস্টের পর থেকে গত সাত মাসে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছেন তারা।

কী বলছে সরকার?

গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত প্রতিবেদনে পরিবহনখাতে চাঁদাবাজির যে চিত্র উঠে এসেছে, সেটি আমলে নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা।

আমরা চেষ্টা করছি। যখনই অভিযোগ পাচ্ছি, তখনই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, বিবিসি বাংলাকে বলেন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান।

বিষয়টি নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের সঙ্গেও আলোচনা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে সরকার। আমরা ইতোমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে বসেছি। কিন্তু তারা তো অস্বীকার করে, বলেন মি. খান।

তারপরও আমরা দেখছি। চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে সেই (পরিবহন) ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল করা হবে, বলেন উপদেষ্টা মি. খান।

অভিযোগ ওঠার পর দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) বিষয়টি নিয়ে কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। সম্প্রতি সরেজমিনে বাস টার্মিনালগুলো ঘুরে চাঁদাবাজির অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও পেয়েছেন কর্মকর্তারা।

বিষয়টিকে এখন আরও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, বিবিসি বাংলাকে বলেন দুদকের উপ-পরিচালক আকতারুল ইসলাম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়