শিরোনাম

প্রকাশিত : ১৬ মার্চ, ২০২৫, ১১:০৩ দুপুর
আপডেট : ১৬ মার্চ, ২০২৫, ০২:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ছিনতাইকারী-অপরাধীর আতঙ্ক: ঢাকায় অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন, বাসা পরিবর্তন করছেন

শত প্রতিবাদ, মিছিল, পদযাত্রার পরও জনমনে ফিরছে না স্বস্তি৷ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়ে গেলেও ছিনতাই আতঙ্কে দিন কাটছে সাধারণ মানুষের

ডয়চে ভেলে: রাজধানী ঢাকায় ছিনতাইকারীদের দাপট বেড়েই চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হয়েও মিলছে না নিরাপত্তা। ছিনতাইকারীর আতঙ্কে বাসা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। 

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ মোড়ে শাকিল আহমেদের একটি মোটরবাইকের গ্যারেজ ছিল। চার মাস আগে এলাকার চিহ্নিত ছিনতাইকারীরা তার গ্যারেজে হামলা চালিয়ে নগদ টাকাসহ অন্তত দেড়লাখ টাকার মালামাল নিয়ে যায়। সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে অভিযোগ করেন শাকিল। সেনাবাহিনী একাধিকবার অভিযান চালিয়েও ছিনতাইকারীদের আটক করতে পারেনি। পরে আরো বিপাকে পড়েন শকিল। 

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, অভিযোগ করে আমি আরো বড় বিপদে পড়ি। ঘটনার এক মাস পর তারা আমার ওপর আবার হামলা চালায়। কোনোমতে রক্ষা পাই আমি। পরে নিরাপত্তার জন্য ওই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। গ্যারেজে একটি অটোরিকশা ছিল, সেটাও তারা জোর করে নিতে চায়। ফলে গ্যারেজও বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।

বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনাকরতে গিয়ে শাকিল বলেন, আমার ব্যবসা বন্ধ। এলাকা ছেড়ে নতুন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছি। তারপরও নিরপত্তাহীনতায় ভুগছি। কারণ, তারা আমাকে এখনো খোঁজে। আমি মাস্ক পরে চলাফেরা করি। কাজ ছাড়া বাসার বাইরে বের হই না। বাসার ঠিকানা তারা জানতে পারলে আমার কী হবে বুঝতে পারছি না। কোনো আয় নাই। স্ত্রীকে নিয়ে থাকি। জমানো কিছু টাকা ছিল তা-ও শেষ হয়ে আসছে।

সন্ত্রাসীদের ওই গ্রুপটি এলাকায় ‘বেড়িবাঁধ ছিনতাইকারী' গ্রুপ নামে পরিচিত। বেপরোয়া ওই গ্রুপের সদস্যরা সেনা অভিযানের সময় গা-ঢাকা দিলেও এখন আবার ফিরে এসে ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধ-কর্ম করে যাচ্ছে।

শাকিল আরো বলেন, আমি মামলা করায় তারা আমাকে টার্গেট করেছে। তারা বেশ কয়েকবার মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়েছে। এখন আমি মোবাইল নম্বরও পরিবর্তন করেছি। তারপরও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাবো কিনা জানি না। আমি এক দুর্বিষহ জীবন পার করছি। এখন একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে চালাই। তা-ও সাবধানে থাকতে হয়। আমাকে শেষ পর্যন্ত হয়ত ঢাকা ছেড়ে যেতে হবে। 

তিনি জানান, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়ে, সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করেও কোনো লাভ হয় না।

তিনি আরো বলেন, অনেক টেলিভিশন চ্যানেল আমার অবস্থা নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাতে ওই ছিনকাইকারীদের কিছুই হয়নি। তারা গ্রেপ্তার হয়নি।

ঢাকার নবীনগর হাউজিং-এর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মালেক মিয়ার ছেলে টুটুল ছিনতাইকারীদের ভয়ে এক মাস ধরে ঘরছাড়া। অপরাধীদের ভয়ে এক অর্থে আত্মগোপন করেই থাকেন তিনি।

মালেক মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, শেখ হাসিনার পতনের এক মাস পরে শেখের টেক এলাকায় আমার ছেলেকে কৌশলে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে ৪০ হাজার টাকা দামের একটি মেবাইল ফোন সেট ও চার হাজার টাকা কেড়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। আমার ছেলে এরপর ১০ দিন হাসপাতালে ছিল।

এলাকায় আমার একটি ছোট চায়ের দোকান আছে। কয়েকদিন আগে সেই দোকানে ঢুকে একই ছিনতাইকারীরা ১০ হাজার টা কা নিয়ে যায়। এখনো তারা হুমকি দিচ্ছে, বলেন তিনি।

''ছিনতাইকারী গ্রুপটি এলাকায় ‘আনোয়ার গ্রুপ' নামে পরিচিত''- জানিয়ে তিনি আরো বলেন, আমি তাদের চিনি না। তবে আমার ছেলে তাদের চেনে, নামও জানে। আমার ছেলে যেহেতু তাদের চেনে, তাই পুলিশকে নাম বলেছে। কিন্তু মামলা করিনি। নাম কেন পুলিশকে জানানো হয়েছে সেজন্য তারা হুমকি দিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের ভয়ে আমার ছেলে গত এক মাস ধরে বাসায় থাকে না। সে কোথায় চলে গেছে তা-ও আমি জানি না। আগে আমার সাথে দোকান করতো। তার স্ত্রী এবং দুই বছরের একটা বাচ্চা আছে।

আমি এখন চরম আতঙ্কে আছি। পুলিশকেও ভয়ে কিছু বলতে পারছি না। কোনদিন তারা আবার আমার দোকানে আসে, বাসায় হামলা চালায়, বলেন তিনি।

ঢাকায় ছিনতাইকারী আর অপরাধীদের এই দৌরাত্ম্যে আরও অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন, বাসা পরিবর্তন করছেন। কারণ, অপরাধীরা এখন অপরাধ করে থামছে না, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে তারা উল্টো হুমকি দিচ্ছে। মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বলছে। ফলে নগরবাসীর মধ্যে ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। লোকজন জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে বের হন না। ঢাকায় রাতে লোক চলাচল অনেক কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যেও।

মোহাম্মদপুরের আসাদ গেট এলাকায় সাগরিকা রায় নামে এক কর্মজীবী নারী পাঁচ মাস আগে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। তার অফিস নিকেতন এলাকায়। সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলেন। হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারী তার মোবাইল ফোন ও কিছু টাকাসহ ভ্যানিটি ব্যাগটি নিয়ে যায়। এরপর তিনি ছিনতাইকারীর ভয়ে বাসা পরিবর্তন করে মগবাজার এলাকায় চলে যান। 

তিনি বলেন, সেখানে যাওয়ার পরও গত মাসে হাতিরঝিলে বেড়াতে গিয়ে আমি একবার ছিনতাইকারীর কবলে পড়ি।

তিনি বলেন, মোহাম্মদপুর এলাকা ছিনতাইকারীর অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বাসা বদল করেও লাভ হয়নি। এখন সবখানেই ছিনতাইকারী।

তার কথা, আসলে এখন সব সময়ই ভয়ের মধ্যে থাকি। ঘরে-বাইরে সবখানে। নিরাপত্তার প্রচণ্ড অভাব বোধ করি। এখন আবার শুরু হয়েছে ধর্ষণ।

মিরপুরের এক বেসরকারি চাকরিজীবী জেসমিন আহমেদ বলেন, বায়িং হাউজে জব হওয়ায় আমাকে অড টাইমেও অফিসে থাকতে হয়। অফিসে সমস্যা হয় না। রাতে বাসায় ফেরার পথে আতঙ্কে থাকি। রিকশা ও অটোরিকশা অনিরাপদ হওয়ায় বাসে চড়ি। কিন্তু এখন তো বাসেও ছিনতাই হয়। আর অব্যাহত ধর্ষণ আরো আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক মো. তৌহিদুল হক বলেন, আসলে প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধগুলো বাড়ছে, কিন্তু প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। তারা এখন চলাচল করতেও ভয় পাচ্ছে। ফলে রাতে মানুষ খুব প্রয়োজন না হলে বের হচ্ছে না। আবার এলাকাও পরিবর্তন করছে। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, তাতেও কোনো লাভ হচ্ছে না। এগুলো জনজীবনকে বিপর্যস্ত করছে।

আর পুলিশ দুই কারণে মামলা কম নেয়। প্রথমত, তারা মামলা কমিয়ে নেয় পরিস্থিতি ভালো দেখানোর জন্য। আরেকটি কারণ হলো; যারা শিকার হন, তাদের মামলায় অনীহা। অনেকেই ঝামেলা এড়াতে মামলা করতে চান না। আর পুলিশ  নানা আইনের ধারায় ডাকাতিকে চুরি, আর চুরির ক্ষেত্রে সাধারণ জিডি নেয়, বলেন তিনি।

তৌহিদুল হক বলেন, আসলে মামলার সংখ্যা বা পুলিশের অপরাধের পরিসংখ্যান দিয়ে আইন-শৃঙ্খলার বাস্তব অবস্থা বোঝা যাবে না। কারণ, অনেক ঘটনাই রিপোর্টেড হয় না। আর মানুষের মধ্যে যখন নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয় তখন সেটা পরিসংখ্যান নিয়ে মাপা যায় না। সমাজের এই ভয়ার্ত অবস্থা সার্বিক বিষয়কে নির্দেশ করে।

পুলিশের সাবেক ডিআইজি আনসার উদ্দিন খান পাঠান ডয়চে ভেলেকে বলেন, আসলে পুলিশকে দৃশ্যমান তৎপরতা চালাতে হবে। তার ভিজিবিলিটি বাড়াতে হবে। বিভিন্ন ধরনের পেট্রোলিং বাড়াতে হবে। সেটা করলে মানুষ আস্থা পাবে। নিরাপত্তাহীনতা কেটে যাবে। কিন্তু সেটা এখন তেমন হচ্ছে না। আর অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সেটাকেও ভিজিবল করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, পরিস্থিতির কারণেই মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। আর এটা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে মানুষ আরো আস্থা হারাবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যেমন নিজেই রাতে থানায় গিয়েছেন, ব্যবস্থা নিয়েছেন, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও এভাবে নিয়মিত যাওয়া দরকার। তারা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন। সেটা হলে আস্থা ফিরবে। তবে পুলিশ এখনো ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। 

অনিশ্চিত পরিস্থিতি তাদের দায়িত্ব পালনে নিস্পৃহ করে। সামনে নির্বাচন হলে কারা ক্ষমতায় আসবে। না হলে কী হবে-এগুলোও তাদের প্রভাবিত করে, বলেন তিনি।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, এটা ঠিক ছিনতাইয়ের মতো আরো কিছু অপরাধ আছে, যা মানুষকে ভীত করে, তাদের মনে নিরপত্তাহীনতা তৈরি করে। এজন্যই আমরা পুলিশের দৃশ্যমান তৎপরতা বাড়িয়েছি। অভিযান বেড়েছে। টহল বেড়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে অনেক ছিনতাইকারী আটক হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব থানাকে আমরা বলেছি যে, অভিযোগ সঠিক হলে যেন মামলা নেওয়া হয়। মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো হয়রানির অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। 

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়