ডয়েচে ভেলে প্রতিবেদন : মেট্রোপলিটন এলাকার ৪৮ থানায় অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই বাহিনীর সদস্যরা বেতন পাবেন না, কিন্তু পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেসি বা বিচারিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর মতো গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পাবেন৷
সহসাই তাদের মাঠে দেখা যাবে বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ(ডিএমপি)।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র বাহিনীকে (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে তার মেয়াদ দুই মাস বাড়ানো হয়। জানুয়ারিতে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৪ জানুয়ারি থেকে আরো ৬০ দিনের জন্য সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার৷ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব সমপদমর্যাদার কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে রাজধানীতে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দিয়ে অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগের প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে৷
ডিএমপির ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) মো. তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, " অক্সিলারি ফোর্সের কাজ হবে স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক, কোনো বেতন থাকবে না। গ্রেপ্তারসহ আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের যে ক্ষমতা আছে তাদেরও সেই ক্ষমতা থাকবে। তারা সিভিল ড্রেসেই থাকবেন। তবে হাতে একটি ব্যান্ড থাকবে। আর তাদের ক্ষেত্রে পুলিশের শৃঙ্খলাবিধিই প্রযোজ্য হবে।”
এর আগে শনিবার ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রথমবারের মতো রাজধানী ঢাকায় পুলিশের অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে শহরের বিভিন্ন এলাকা ও প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা কর্মী হিসাবে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়ার কথা জানান। তারা পুলিশের সহায়ক হিসাবে কাজ করলেও তাদের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা থাকবে বলেও জানান তিনি। তিনি আরো জানান, নিরাপত্তাকর্মীর বাইরে আগ্রহী সাধারণ মানুষও এই কাজে নিয়োজিত থাকবেন, তবে তারা অস্ত্র বহন করতে পারবেন না।
মূলত আসন্ন ঈদে আইন-শঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়েই অক্সিলারি ফোর্সের প্রসঙ্গে কথা বলেন তিনি। এ সময় ঈদের দিনগুলোতে যার যার বাসা-বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিজস্ব উদ্যোগে বজায় রাখার আহ্বানও জানান তিনি।
পুলিশে হঠাৎ করে এই অক্সিলারি ফোর্সের কেন প্রয়োজন পড়লো? জনবলসংকটই এর একমাত্র কারণ কিনা জানতে চাইলে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার তালেবুর রহমান বলেন, " অর্গানোগ্রামে যে জনবল আছে, আমাদের তা আছে। তারপরও পুলিশের সাথে নগরবাসীর সম্পর্ক তৈরি করা এবং পুলিশ-পাবলিক পার্টনারশিপের অংশ হিসাবে করা হচ্ছে।” তিনি আরো বলেন, "১৯৭৬ সালের ডিএমপি অর্ডিন্যান্সের ১০ ধারা অনুয়ায়ী, পুলিশের কাজে সহায়তার জন্য পুলিশ কমিশনার অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগ দিতে পারেন। তার আওতায় এই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট ও আদাবর থানা ছাড়া বাকি ৪৮ থানায় তাদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সহসাই তারা কাজে নামবেন। পুলিশ কমিশনার তাদের প্রত্যেককে একটি সার্টিফিকেট দেবেন, তার ভিত্তিতে তারা কাজ করবেন।”
পুলিশের নিয়ম মেনে তাদের যাবতীয় বিষয় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে, পুলিশ আইনে যে রক্ষাকবচ আছে তা তারা পাবেন, যে শাস্তির বিধান আছে তা-ও তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলেও দাবি করেন তিনি৷ তবে এমন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গ্রেপ্তারের ক্ষমতাসহ নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কোনো বেতন ছাড়া কেন কাজ করবেন জানতে চাইলে তালেবুর রহমান বলেন, " এখানে যারা বেতন ছাড়া কাজ করতে পারবেন, আমরা তাদেরই নিয়োগ দেবো। এটা জনসেবার মতো। যারা করতে চান, তারা করবেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক মো. তৌহিদুল হক বলেন, "এটা স্পষ্ট যে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতির কারণেই ডিএমপি অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৫ আগস্টের পর পুলিশ এখনো আগের অবস্থায় ফিরে যায়নি। আর আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। ‘মব জাস্টিস', হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই ব্যাপকহারে বেড়েছে। ফলে হয়েতো পুলিশ চাইছে যেসব প্রাইভটে সিকিউরিটি ফোর্স আছে তাদের নিরাপত্তার কাজে লাগাতে।”
"কিন্তু এখানে একটা রিস্ক রয়ে গেছে। যারা বিনা বেতনে কাজ করতে আসবেন. তারা কেন আসবেন? ফলে তারা নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। আবার তাদের প্রভাবশালীরা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহারও করতে পারে। তাদের নিয়োগেও নানা প্রভাব থাকতে পারে। পুলিশ এটা কিভাবে মনিটরিং করবে তা-ও এখনো স্পষ্ট নয়। এর আগে কমিউিনিটি পুলিশের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি দেখা গেছে। তেমন সুফল পাওয়া যায়নি। উল্টো তাদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িয়ে পড়া বা অপরাধীর সহায়ক হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।”
তিনি মনে করেন, " তাদের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়া কোনোভাবেই ঠিক না। এটা দেয়া হলে এই গ্রেপ্তারিতে ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা আছে। এই ক্ষমতাকে তারা অর্থ আদায়ে অথবা কারুর হয়ে ব্যবহার করতে পারে। এতে উল্টো আরো সমালোচনার মুখে পড়তে পারে পুলিশ। তারা বড়জোর আটক করতে পারে। আটক করে তারা থানায় সোপর্দ করতে পারে, এর বেশি কোনো ক্ষমতা তাদের দেয়া ঠিক না। আমাদের বুঝতে হবে, বেতন ছাড়া তারা কেন কাজ করবেন? তাদের লাভ কী?”
পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ অক্সিলারি ফোর্স সম্পর্কে বলেন," পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে বলেন আর পারসেপশনের দিক দিয়ে বলেন, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে। পুলিশ চেষ্টা করেও উন্নতি করতে পারছে না। ফলে এখন তারা সাময়িকভাবে এই অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগ করে পরিস্থিতির উন্নতির চেষ্টা করছে।”
"ডিএমপি অর্ডিন্যান্সে সাময়িকভাবে এই নিয়োগের বিধান আছে। তবে এটা কতটা কাজে আসবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এটা ঈদের সময় শহর ফাঁকা থাকে, তাই হয়তো সাময়িকভাবে তারা নিয়োগ করবে। আসলে নিয়োগ কেমন হবে, কী ভিত্তিতে , কাদের নিয়োগ করা হবে তার ওপরে এর সফলতা নির্ভর করছে,” বলেন তিনি।
২০২৩ সালে আনসার সদস্যদের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়ার একটি প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় পাস হলেও পুলিশ ও বিভিন্ন মহলের বিরোধিতার মুখে আর সংসদে ওঠেনি।
পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, " আইন-শৃঙ্খলার একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে। ফলে সাময়িকভাবে অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগ করা হচ্ছে ডিএমপিতে। এটা ভালো- যদি কাজে লাগে। ডিএমপির বিধানে এটা আছে।”
"তবে এর সফলতা নির্ভর করবে কতটা নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়- তার ওপর। তাদের কাজের মনিটরিং কীভাবে করা হবে তা-ও গুরুত্বপূর্ণ, ” বলেন তিনি।