মানবজমিন প্রতিবেদন: পত্রিকা অফিসের সামনে অবস্থান। বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর। সর্বশেষ ছাত্রী হেনস্তায় অভিযুক্ত ঢাবি কর্মচারীকে ছাড়াতে শাহবাগ থানায় রাতভর তুলকালাম কাণ্ড। কারা জড়িত এসব ঘটনায়? কারা কথিত এ তৌহিদী জনতা? সাংবাদিক কদরুদ্দিন শিশির এ নিয়ে একটি অনুসন্ধান করেছেন। যা তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। ছাত্রী হেনস্তা ও থানায় মব করার ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের নেতারাও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সংগঠনটি মনে করে, একজন হ্যারাসারকে যখন মুসলমানরাই ইসলামের সিম্বল বানিয়ে ফেলে সেটা ইসলামের জন্য অপমানজনক।
ফ্যাক্টচেকার কদরুদ্দিন শিশির এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে সামপ্রতিক অতীতে আরও কয়েকটি ঘটনার ছবি বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে, শাহবাগের এই ঘটনাটি (তৌহিদী জনতা’র কাণ্ড বলে চালানো) আরও অনেক ঘটনা রেন্ডম ‘ধার্মিক সাধারণ জনতা’ এর তাৎক্ষণিক ক্ষোভ থেকে উৎসারিত স্বতস্ফূর্ত ঘটনা নয়। বরং এগুলো কো-অর্ডিনেটেড ঘটনা। আমি সামপ্রতিক ৩টি ঘটনার কিছু ছবি/ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছি। ঘটনা তিনটি হলো, গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রথম আলো পত্রিকার সামনে ২ দিনব্যাপী বিক্ষোভ এবং গরু জবাই কর্মসূচি, ডেইলি স্টার পত্রিকার ভবনের গেট বন্ধ করে বিক্ষোভ এবং জুমার নামাজ আদায় কর্মসূচি এবং গতকাল রাতে শাহবাগ থানায় আটক নারী হয়রানিকারী যুবককে ছাড়িয়ে নেয়ার ঘটনা। এই তিনটি ঘটনায় কয়েকশ’ লোককে জড়ো করে সামনের সারিতে থেকে তাদের নেতৃত্ব দেয়া অন্তত ৩ জন লোক সব জায়গায় কমন।
এদের মধ্যে ২ জনের নাম ও পরিচয় জানা গেছে। একজন আবু সাঈদ শের মোহাম্মদ খান, যার ফেসবুক প্রোফাইল (Sher Muhammad)। শের মোহাম্মদকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার অর্থ সরবরাহকারী সদস্য হিসেবে আটক করে র্যাব। অনলাইন শরিয়াহ গ্রাজুয়েশন ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সে। ৫ই আগস্টের পর আল-ক্বায়দার কালো পতাকার সমর্থনে প্রচারণা চালাতে দেখা যায় তাকে। ২০১৫ সালে হাটহাজারিতে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা হয়। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সামনে বিক্ষোভে তাকে নেতৃত্ব দিতে একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে। শাহবাগের বুধবার রাতের ঘটনায় তাকে ‘আমীর‘ হিসেবে ঘোষণা করে একটি ভিডিও বক্তব্য দিয়েছেন আতাউর রহমান বিক্রমপুরী, (যার পরিচয় নিচে দেয়া হলো)।
এতে আরও বলা হয়, দ্বিতীয় ব্যক্তিটি হলেন, আতাউর রহমান বিক্রমপুরী। তিনি প্রথম আলোর সামনের বিক্ষোভে এবং সেখান থেকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া কয়েকজনকে থানা থেকে জোরপূর্বক ছাড়িয়ে নেয়াতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং শাহবাগ থেকে নারী হয়রানিকারীকে ছাড়িয়ে নিতেও তিনি যশোর থেকে ঢাকায় এসে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিক্রমপুরী তার ওয়াজ, অনলাইন বয়ান ও ফেসবুকে অতি উগ্র কথাবার্তা প্রচারের জন্য পরিচিত। সম্প্রতি তিনি তার এক ফেসবুক পোস্টে বায়তুল মোকাররমের বর্তমান খতীব মাওলানা আব্দুল মালেককে মুনাফেক এবং ‘তাগুতের কুকুর’ বলে অভিহিত করেন।
এ ছাড়া তিনি ‘এন্টি শাতিম মুভমেন্ট’ নামে একটি ফেসবুক পেইজ চালান যেখানে গত ২২শে ফেব্রুয়ারি এক পোস্টে ‘শাতিমে রসুল’ হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করা গেলে তাকে হত্যার আহ্বান জানানো হয়। গণতন্ত্র চর্চাকারী মুসলিমদেরকে ‘কাফির’ মনে করে তিনি নিয়মিত পোস্ট করেন এবং বয়ান করেন। নাস্তিকদের হত্যা করার জন্যও তিনি উস্কানি দেন। আইএসকে খারেজি মনে করলেও আল-কায়দা ও তালিবানকে হক্বপন্থি দল বলে প্রচারণা চালান। ২০২১ সালে তাকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম সদস্য হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। আতাউর কারাগারে থাকা জঙ্গিদের মুক্তির জন্য কাজ করা বৈষম্যহীন কারামুক্তি আন্দোলনের একজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং ৫ই আগস্টের পর তিনি তার দলবল নিয়ে কাশিমপুর কারাগার থেকে জঙ্গিদের মুক্ত করে আনার জন্য জড়ো হয়ে কর্মকর্তাদের জেরা করেন।
তৃতীয় আরেকজন ব্যক্তি উপরের তিনটি ঘটনাই শের মোহাম্মদের পাশে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে কিন্তু তার পরিচয় জানা যায়নি। অর্থাৎ, ‘তৌহিদী জনতা’র স্বতস্ফূর্ত কাণ্ড বলে প্রচার চালানো হলেও দেখা যাচ্ছে এই ঘটনাগুলোতে মানুষ জড়ো করার পেছনে উগ্রপন্থি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয় ব্যক্তিদের কো-অর্ডিনেশনের বিষয়টি স্পষ্ট।
হ্যারাসারকে ইসলামের সিম্বল বানিয়ে ফেলা ইসলামের জন্য অপমানজনক: ঢাবি শিবির
এদিকে হ্যারাসার মোস্তাফা আমির অর্ণবের পক্ষ নেয়ার তীব্র বিরোধিতা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনটির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সেক্রেটারি মহিউদ্দিন খান এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, একজন হ্যারাসারকে যখন মুসলমানরাই ইসলামের সিম্বল বানিয়ে ফেলে সেটা ইসলামের জন্য অপমানজনক।
হ্যারাসারকে ফুল দিয়ে বরণ করে, বীর হিসেবে উপস্থাপন করে যারা এমন হ্যারাসমেন্টে উৎসাহ দিলেন, তাদের কাজের খেসারত এই অঞ্চলের মুসলমানদের দিতে হবে সামনে। সংগঠনটির ঢাবি শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম বলেন, বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ, শক্তিশালী ও গঠনমূলক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই আমাদের লক্ষ্য। তবে, এই অগ্রযাত্রায় বার বার বাধা সৃষ্টি করছে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল, যারা হয় অজ্ঞতাবশত, নয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। একজন অপরাধীকে কেন্দ্র করে সফলতার উচ্ছ্বাস দেখানো শুধু গর্হিতই নয়, বরং তা জাতীয় মূল্যবোধের অবমাননা। হাজারো শহীদের আত্মত্যাগ যে উর্বর ভূমি আমাদের জন্য তৈরি হয়েছে, সেখানে অযৌক্তিকভাবে শাহবাগকে পুনর্বাসন করার মঞ্চ তৈরি করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছুই নয়।
অন্যদিকে রাতে শাহবাগ থানায় যাওয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এসএম ফরহাদ। তিনি এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, শাহবাগ থানার ওসি রাত ১টার দিকে কল দিয়ে জানালেন- “থানার অবস্থা খুব একটা ভালো না, অপরাধীকে ছাড়িয়ে নিতে কিছু মানুষ থানার সামনে অবস্থান নিয়েছে এবং এই পরিস্থিতি বড় কোনো সংকট ও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।” সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ভিক্টিম বোনটির সঙ্গে যোগাযোগ করার নানা চেষ্টা করি। কিন্তু গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে থাকাটা স্বাভাবিক ছিল, তাই কাউকেই কানেক্ট করতে পারিনি।
সাহরীর সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বোনটির সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রমনা জোনের ডিসি মাসুদ ভাই-এর সঙ্গে আলাপ করে একমত হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার অংশ হিসেবে থানায় যাই এবং সেখানে অবস্থানরত ‘তৌহিদী জনতা’র দাবি ও অবস্থান জানার চেষ্টা করি। তাদের দাবি ছিল- ‘অর্র্ণবকে কোর্টে তোলা যাবে না, এখানেই মুক্তি দিতে হবে।’ এইটা শুধু স্বাভাবিক দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; সেখানে অবস্থানরতরা একসঙ্গে হাতে হাত রেখে নিজেরা শপথও করে ফেলছেন- তারা জীবন গেলেও এখান থেকে সরবে না। অবস্থা ক্রিটিক্যাল দেখে তাদেরকে বোঝানোর বহু চেষ্টা করতে যেয়ে উল্টো একাধিকবার বাকবিতণ্ডার শিকারও হই।
পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সহকারী প্রক্টর স্যার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়কসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের প্রচেষ্টায় ওনাদের কর্মসূচি পরিবর্তনের ব্যাপারে দীর্ঘ সময় নানা অ্যাপ্রোচে রিকোয়েস্ট করা হয় এবং লিগ্যাল প্রসিডিউর মেইনটেইন করার ব্যাপারে ওনারাও কনভিন্সড হয়। আমাদের আশঙ্কা ছিল- এই বিষয়কে কেন্দ্র করে ঠিক যতটুকু অপরাধীর শাস্তি কিংবা ভিক্টিম বোনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাবার কথা, সেটা না হয়ে বরং বড় কোনো অস্থিরতা বা সংকট তৈরি হতে পারে এবং এই সুযোগে নানা প্রান্তিক রাজনৈতিক গ্রুপ নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে অহেতুক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
সবশেষে আমরা পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করে অর্ণবকে নিয়ে গাড়ি কোর্টে নেয়ার নিশ্চয়তা নিয়ে ফিরি। নোকতা-১. অর্ণবের অ্যাপ্রোচ ও শব্দচয়ন হ্যারাসমেন্টের অ্যাপ্রোচ, এইটারে জাস্টিফাই করবার সুযোগ নাই। ২. অর্ণবের হাতে কুরআন দিয়ে বিজয়ী স্লোগান ও আপনার ‘দ্বীনি’ ভূমিকা এই অঞ্চলের মুসলমানদের কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না; বরং বহুগুণ প্রশ্নবিদ্ধ করবে।