বণিকবার্তা প্রতিবেদন: সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর বৈধভাবে অবস্থান করছিলেন ৩৭ হাজার ৪৬৪ জন ভারতীয় নাগরিক। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এ সংখ্যা আরো বেড়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের বিশেষ শাখার গত ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, এরই মধ্যে দেশে বৈধভাবে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ৪৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে দেশে বৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশীদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে ভারতীয়রাই শীর্ষে। তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ দেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কাজ করছেন। আবার একাংশ পড়াশোনা করছেন দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
অবৈধভাবে অবস্থানকারীদের দিক থেকেও ভারতীয়রা শীর্ষে। তাদের মধ্যে একাংশ বাংলাদেশে এসেছিলেন বৈধভাবে। কিন্তু পাসপোর্ট বা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তারা অবৈধভাবে থেকে গেছেন। পুলিশের হিসাবে, বাংলাদেশে এভাবে অবস্থানরত ভারতীয়ের সংখ্যা ৭ হাজার ৪৭২। তাদের অনেকেই আত্মগোপনে থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন বলেও তথ্য রয়েছে।
আর কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই দেশে অনুপ্রবেশ করে থেকে যাওয়া কয়েক লাখ বিদেশীর মধ্যেও ভারতীয়ের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।
দেশে বৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশীদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের বিশেষ শাখার ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদকৃত হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন বৈধভাবে অবস্থান করছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ বিদেশী। এর মধ্যে ভারতীয় ৪৫ হাজার। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মার্কিন পাসপোর্টধারীরা। দেশে এখন বৈধভাবে মার্কিন নাগরিক অবস্থান করছেন ১৩ হাজার। তাদের বড় একটি অংশ আবার যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক। তৃতীয় অবস্থানে থাকা চীনের নাগরিক আছেন ১০ হাজার ৫০০। এ অনুযায়ী দেশে বৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশীদের ৫৭ শতাংশের বেশি এ তিন দেশের নাগরিক।
এছাড়া যুক্তরাজ্যের নাগরিক আছেন ৭ হাজার ৫০০। এর বাইরে কানাডার ৪ হাজার ৫০০, নেপালের ৩ হাজার ৫০০, রাশিয়ার ৪ হাজার ৫০০, জাপানের ৪ হাজার ৫০০, শ্রীলংকার ২ হাজার ৫০০, পাকিস্তানের ২ হাজার, ইতালির ২ হাজার, বেলারুশের ৫০০, ইন্দোনেশিয়ার ৫০০, জাপানের ৫০০, ভুটানের ৩০০, পর্তুগালের ১৫০, ফিনল্যান্ডের ১০০ ও আর্জেন্টিনার ২২ জন বৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। আর অন্যান্য দেশের নাগরিক আছেন ১৭ হাজার ৯২৮ জন। তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন।
এর বাইরে পাসপোর্ট বা ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও অবৈধভাবে অবস্থান করছেন ৯৭টি দেশের ১৩ হাজার ৫৭১ জন নাগরিক। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের মধ্যে ভারতীয় আছেন ৭ হাজার ৪৭২ জন। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার ১ হাজার ১৭ জন, চীনের ৯৮১, শ্রীলংকার ১৮৭, যুক্তরাজ্যের ২৩১, কানাডার ৯৭ ও নাইজেরিয়ার ৪৬১ নাগরিক প্রয়োজনীয় নথির মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।
তবে কাগজপত্রের বাইরে অবৈধভাবে কয়েক লাখ বিদেশীর বাংলাদেশে অবস্থানের তথ্য রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। তাদের মধ্যে সিংহভাগই ভারতীয়।
এরই মধ্যে অবৈধভাবে দেশে অবস্থান করা বিদেশীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে সরকার। যদিও অবৈধভাবে অবস্থানরত এসব বিদেশীর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি।
এ বিষয়ে বাহিনীগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আইনি দুর্বলতা ও বিদেশী নাগরিকদের সমন্বিত কোনো তথ্যভাণ্ডার না থাকায় বিনা বাধায় বাংলাদেশে বসবাসের সুযোগ পাচ্ছেন অবৈধভাবে থেকে যাওয়া বিদেশীরা। তাদের অনেকেই মাদক ব্যবসা, উপহারের নামে প্রতারণা, এটিএম জালিয়াতি, বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রার কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, স্বর্ণ চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো ও মানব পাচারসহ সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন এবং কর ফাঁকি দিয়ে উপার্জিত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে নিজের দেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের ভিসা নীতিমালা অনুযায়ী ইউরোপের সব দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, মিসর, ব্রুনেই ও তুরস্ক ছাড়াও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৩টি দেশের নাগরিকদের অন অ্যারাইভাল ভিসা দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অন অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধার আওতায় থাকা দেশগুলোর অধিকাংশেরই কোনো না কোনো নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন।
অবৈধ বিদেশী নাগরিকদের বিষয়ে কয়েকদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশীদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বৈধতা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের সতর্কতা জারি করার পরও দেশে অবস্থানরত অবৈধ বিদেশীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোনো বিদেশী নাগরিকের অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থানের সুযোগ বা আইনি বৈধতা নেই। যেসব বিদেশী নাগরিক অবৈধভাবে দেশে অবস্থান করবেন, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে সবাইকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করার অনুরোধ করা হলো।’
আপনার মতামত লিখুন :