রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে প্রতিটি কবর দেওয়ার ক্ষেত্রে চাঁদাবাজির শিকার হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নির্ধারিত মূল্যের বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। গত ৫ আগস্টের পরপর কবরস্থানে কবর দেওয়ার কাজটি অন্যের দখলে চলে যায়। কবর দেওয়ার জন্য নির্ধারিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মায়া ট্রেডার্সকে বের করে দেয় একটি চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। এখন ঐ সিন্ডিকেট প্রতিটি কবর দেওয়ার ক্ষেত্রে ২ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা চাঁদাবাজি করছে। দিনে ৫০ হাজার টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। সূত্র : ইত্তেফাক
২৭ একর জমির ওপর আজিমপুর কবরস্থান ঢাকার সবচেয়ে পুরোনো কবরস্থান। মোগল যুগে শায়েস্তা খাঁর আমলে সপ্তদশ শতাব্দীতে কবরস্থানটি চালু হয়। আজিমপুর কবরস্থানটি পাশাপাশি দুইটি স্থানে রয়েছে। পুরাতন কবরস্থানটির জায়গা ছোট। নতুন কবরস্থানটি অনেক বড়। নতুন কবরস্থানে এখন কবর দেওয়া হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দরপত্রের মাধ্যমে প্রতি বছর একজন ঠিকাদার নিযুক্ত করে কবর দেওয়ার কাজটি করে। কবর দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত বাঁশ ও চাটাই নির্দিষ্ট ঠিকাদার সরবরাহ করে। মৃত ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে বাঁশ ও চাটাইয়ের মূল্য ঠিকাদারকে পরিশোধ করতে হয়। এজন্য সিটি করপোরেশন থেকে বাঁশ ও চাটাইয়ের একটি মূল্য বেঁধে দেওয়া রয়েছে। মৃত ব্যক্তি ১০ বছর থেকে তদূর্ধ্ব বয়সের কবরে বাঁশ ও চাটাইয়ের জন্য নির্ধারিত মূল্য ৮৬৫ টাকা। তিন বছর থেকে নয় বছর বয়সের মৃতের কবরের জন্য ৩৬২ টাকা এবং ১ দিন থেকে ৩ বছর বয়সের মৃতের জন্য ১৬১ টাকা পরিশোধ করতে হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে। এছাড়া প্রতিটি কবরের জন্য মৃতের পরিবার থেকে সিটি করপোরেশনের কাছে রেজিস্ট্রেশন ফি ১ হাজার টাকা জমা দিতে হয়।
বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আজিমপুর কবরস্থানে বাঁশ ও চাটাই সরবরাহের ঠিকাদারি কাজ পায় মেসার্স মায়া ট্রেডার্স। চলতি বছরের ৩০ জুন তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এর আগে পরবর্তী সময়ের জন্য কবরস্থানের ঠিকাদারি কাজ পায় মেসার্স নয়ন চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লব পরিস্থিতিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সমাজ কল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন শাখা থেকে বলা হয়, নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান না আসা পর্যন্ত পূর্বের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কবরস্থানের কাজ চালিয়ে যেতে।
আজিমপুর কবরস্থানে মেসার্স মায়া ট্রেডার্সের নিযুক্ত একজন ব্যক্তি জানান, ৫ আগস্ট রাতেই আজিমপুর এলাকার একজন বিএনপি নেতা তাদের কাছে ফোন করে কবরস্থানের কাজ বন্ধ করতে বলে হুমকি দেয়। বিষয়টি নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩-এর সমাজ কল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন শাখার সহকারী কর্মকর্তা মাসুদ হাসানের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়। পরে অঞ্চল-৩-এর নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউর রহমান মেসার্স মায়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারীর কাছে ফোন করে কবরস্থানের কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। এ ঘটনার কয়েক দিন পরই আজিমপুর এলাকার এক বিএনপি নেতার নেতৃত্বে ৪০/৫০ জন কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে ঠিকাদারি কাজ দখল করে নেয়।
আজিমপুর কবরস্থানের গোরখোদক আব্দুর রহিম বলেন, কবরস্থানে কাউকে কবর দেওয়ার পর মৃতের পরিবারের পক্ষ থেকে গোরখোদকদের খুশি হয়ে যা দেয় তা-ই তারা নেন। অনেক সময় দরিদ্র পরিবারের কারও লাশ হলে তারা কোনো টাকা নেন না। তবে বাঁশ-চাটাইয়ের মূল্যবাবদ ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা নেওয়া হয়।
গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে কবরস্থানে প্রতিটি কবর দেওয়ার জন্য বাঁশ-চাটাই বাবদ ২ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ২০-৩০টি কবর দেওয়া হয়। দিনে ৫০ হাজার টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে এই কবরস্থানে।
এ ব্যাপারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সমাজ কল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন শাখার প্রধান কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, ‘নতুন ঠিকাদার কবরস্থানে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কেন তারা কাজ করবে না, এটি আমরা জানি না। কবরস্থান সিটি করপোরেশনের একটি সমাজকল্যাণমূলক কাজ। এ কারণে আমরা আবারও মেসার্স মায়া ট্রেডার্সকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছি। এ ব্যাপারে গত ২৯ অক্টোবর চিঠিও দেওয়া হয়েছে।’
মেসার্স মায়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আব্দুল মালেক বলেন, ‘আমরা চিঠি পেয়েছি। কিন্তু আজিমপুরের স্থানীয় একজন নেতার লোকজন কবরস্থানের কাজ দখল করে নিয়েছে। আমাদের পক্ষে তাদের সঙ্গে আপোস করে কবরস্থানের কাজ চালানো সম্ভব নয়। কবরস্থানে বাঁশ-চাটাই সরবরাহ ও এর মূল্য আদায় এখন তারাই করছে।
এ ব্যাপারে আজিমপুর এলাকার ২৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, ‘আগে সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের কাছের লোক অনিক কবরস্থানে বাঁশ-চাটাই সরবরাহের কাজ করত। ৫ আগস্টের পর সে পালিয়ে যায়। এ অবস্থায় বাঁশ-চাটাই না পেলে তো কবর দেওয়া সম্ভব নয়। তাই জরুরিভিত্তিতে স্থানীয় ফারুক নামে এক ব্যক্তিকে আমি কবরস্থানে বাঁশ-চাটাই সরবরাহ করতে বলেছি।’
চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৮৬৫ টাকার এক টাকাও বেশি নেওয়া হচ্ছে না। আমি প্রতিদিন খোঁজ রাখছি। চাঁদাবাজি করার প্রশ্নই ওঠে না। এটি একটি কল্যাণমূলক কাজ। আমি চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নই। কেউ জড়িত থাকলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :