লিফটে উঠে দোতলায় পা রাখতেই আলো-আঁধারি। বন্ধ দরজা ভেদ করে সুবাস মিশ্রিত ধোঁয়া এসে পড়ছে লবিতে। দরজায় লেখা ‘থার্টিটু ডিগ্রি’। ভেতরেও অল্প আলো, তার মধ্যেই ধোঁয়া আর ধোঁয়া। চলছে হিন্দি গান। আটটি সোফা সেট। কোনোটিতে দু’জন, কোনোটি একজন। সবার হাতেই সিসার পাইপ। পাইপ টেনে ধোঁয়া ছাড়ছেন, উল্লাসে মাতছেন।
এটি একটি সিসা লাউঞ্জ। রাজধানীর বনানী এলাকার এইচ ব্লকের একটি ভবনে এর অবস্থান। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার নামে রাজধানীর অনেক স্থানে চলে এমন সিসার কারবার। লাউঞ্জে ঘণ্টাখানেক বসার পর পর্দা দিয়ে ঘেরা স্থান থেকে দুই তরুণীকে বের হয়ে আসতে দেখা গেল। তখন ভেতরে পুরুষের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল।
বনানী, গুলশান, উত্তরা ও ধানমন্ডি এলাকায় এমন লাউঞ্জ রয়েছে ২০টির বেশি। সম্প্রতি অন্তত ১০টি সিসা লাউঞ্জে সরেজমিন ঘুরে প্রতিটিতেই প্রায় অভিন্ন চিত্র দেখা যায়। রাতভর চালু থাকে লাউঞ্জ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) বলছে, সিসা ‘খ’ শ্রেণির মাদক হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে অন্তর্ভুক্ত। ফলে এ ধরনের লাউঞ্জ অবৈধ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা আছে, শূন্য দশমিক ২ শতাংশের বেশি নিকোটিনযুক্ত যে কোনো তরল বা পানীয় ‘খ’ শ্রেণির মাদক। সিসা বিভিন্ন ধরনের ভেষজের নির্যাস সহযোগে ০.২ শতাংশের বেশি নিকোটিন এবং এসেন্স ক্যারামেল মিশ্রিত স্লাইস দিয়ে তৈরি। এটি বহন, সংরক্ষণ ও ক্রয়-বিক্রি করার অপরাধে এক বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর শাস্তির বিধান রয়েছে।
ডিএনসির কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের পরীক্ষায় লাউঞ্জের সিসায় মাত্রারিক্ত নিকোটিন থাকার প্রমাণও মিলেছে। গত সেপ্টেম্বরে ডিএনসির কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে ৯টি পৃথক আলামত পরীক্ষা করা হয়। প্রতিটিতে শূন্য দশমিক ২ শতাংশের বেশি নিকোটিন পাওয়া যায়। এর আগে ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগার ১৯টি লাউঞ্জের সিসায় মাত্রারিক্ত নিকোটিন থাকার প্রমাণ পেয়েছিল। এর মধ্যে ছিল বনানীর থার্টিটু ডিগ্রি, হেজ রেস্টুরেন্ট, আরগিলা রেস্টুরেন্ট, আল গেসিনো ও কিউডিএস এবং গুলশানের মনটনা লাউঞ্জ। কিন্তু দিব্যি চলছে সেসব প্রতিষ্ঠান।
ডিএনসির কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা সমকালকে বলেন, ডিএনসির ঢাকা উত্তরের কার্যালয় থেকে সম্প্রতি সিসার যেসব নমুনা পাঠিয়েছে, সেসবে শূন্য দশমিক ২ শতাংশের বেশি নিকোটিন পাওয়া গেছে। এটি সেবন করলে শ্বাসকষ্টসহ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
আইনে নিষিদ্ধ হলেও প্রকাশ্যেই চলছে সিসার কারবার। দেখেও না দেখার ভান করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দীর্ঘদিন পর সম্প্রতি তিনটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তর কার্যালয়। যে তিনটিতে অভিযান চালিয়েছিল, সেগুলো এখনও চলছে। শুধু তাই নয়, এর আশপাশেও একাধিক সিসা লাউঞ্জ চলছে।
বনানী এলাকার সিসা লাউঞ্জের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন সাতজন জানিয়েছেন, লাউঞ্জ থেকে ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তর কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রতি মাসে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া থানা পুলিশও টাকা পায়। এক প্রশ্নের জবাবে একটি লাউঞ্জের একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বোঝেন না, তিনটিতে অভিযান চালানোর পর কেন অন্যগুলোতে অভিযান চলেনি?’
যদিও ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তর বিভাগের উপপরিচালক শামীম আহমেদ দাবি করেছেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। যে প্রতিষ্ঠানে ০.২ শতাংশের বেশি নিকোটিন পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো থেকে আলামত জব্দ ও সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে।’
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তর কার্যালয় বনানীর ই ব্লকে ‘আল গ্রিসিনো রেস্টুরেন্ট’ নামের সিসা লাউঞ্জে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। সেখান থেকে ৫ কেজি সিসা জব্দ করা হয়। লাউঞ্জটির মালিক জহিরুল ইসলাম সিমু।
গত বুধবার দুপুরে সেখানে সরেজমিন জানা গেল, আল গ্রিসিনো রেস্টুরেন্ট ব্যবসার আড়ালে সিসা বিক্রি করে। লাউঞ্জটি প্রতিদিন সন্ধ্যায় খোলা হয়। চলে ভোর পর্যন্ত। এর পাশের ভবনের আটতলায় মারবেলা নামে একটি সিসা লাউঞ্জ রয়েছে। বুধবার দুপুর ১টায় ই ব্লকের আরেকটি ভবনের ছয়তলায় গিয়ে দেখা যায়, হেজ রেস্টুরেন্ট নামের প্রতিষ্ঠানের সিসা বেচাকেনা চলছে। আগের দিন মঙ্গলবার রাতে ১১ নম্বর সড়কের ডি ব্লকের একটি ভবনের চারতলায় আরগিলা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা গেল, তিন খদ্দের বসে আছেন। তাদের মধ্যে একজন পাইপে সিসা টেনে ধোঁয়া ছাড়ছেন। মিনিট দশেক বসতেই দেখা গেল, ভেতরের একটি ঘর থেকে এক তরুণী বেরিয়ে আসছেন। জানা গেল, ক্যাশ কাউন্টারের সামনে ছাড়াও সিসা সেবনের আলাদা ঘরও রয়েছে সেখানে।
বনানীর সি ব্লকের ১১ নম্বর সড়কের একটি ভবনের পাঁচতলায় আগে ‘জাজ রিলোডেড লাউঞ্জ’ নামে একটি সিসা লাউঞ্জ ছিল। প্রতিষ্ঠানটি এখন নেই। তবে অ্যারাবিয়ান রেস্টুরেন্ট নামে নতুন একটি রেস্টুরেন্ট করা হয়েছে সেখানে। রাত যত গভীর হয়, তরুণ-তরুণীর ভিড় ততই বাড়তে থাকে।
ওই ভবনের একটি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করে বলেন, প্রায় দুই মাস আগে একদিন বিকেলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি দল অ্যারাবিয়ান সিসা লাউঞ্জে আসে। সিসার আলামত নিয়ে যান তারা। পরদিন সন্ধ্যায় আবার আসেন তারা। সহকারী ম্যানেজারকে ধরে নিয়ে যায়। জেল খেটে কয়েক দিন পর ম্যানেজার জামিনে বেরিয়ে এসে চাকরি ছেড়ে দেন।
ওই ব্যক্তি আরও বলেন, অভিযানের পর পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজনকে ‘ম্যানেজ’ করে সিসা লাউঞ্জ চালানো হচ্ছে।
একই সড়কে আরেকটি ভবনের ১৩ তলায় সিগনেচার নামে একটি সিসা লাউঞ্জ রয়েছে। বুধবার ওই ভবনের কয়েকটি দোকানের কর্মচারী ও নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিকেলে সিগনেচারের কর্মচারীরা লাউঞ্জ খোলেন। সন্ধ্যা থেকে সিসার গ্রাহকরা আসেন সেখানে। এটি সারারাত খোলা থাকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভবনের একটি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারী জানান, একটি সিসা লাউঞ্জ ভবনটির পরিবেশ নষ্ট করে ফেলেছে। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস নেই কারও।
ডিএনসির পরিচালক তানভীর মমতাজ বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত সিসা বার ও অ্যালকোহল বারে অভিযান চালাচ্ছি। এটা অব্যাহত থাকবে। সূত্র : সমকাল
আপনার মতামত লিখুন :