শিরোনাম
◈ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সফলতা চান রাজনীতিবিদরা ◈ ফরিদপুরের প্রতিমা ভাঙচুর করা ব্যক্তি ভারতীয় নন, গোপালগঞ্জের নাগরিক ◈ খাগড়াছড়ি থেকে পুলিশ পরিদর্শক মাজহার গ্রেফতার ◈ আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনে অভিজ্ঞতা ছাড়াই চাকরি ◈ আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করব: অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম (ভিডিও) ◈ বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ, কলকাতায় ইলিশের কেজি ৫ হাজার টাকা ◈ জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউ‌ন্ডেশনে ১০০ কোটি টাকা দিলো সরকার ◈ শাহজালালে বিদেশ ফেরত যাত্রীর সঙ্গে অসদাচরণ, বরখাস্ত ৩ কর্মকর্তা  ◈ অন্তর্বর্তী সরকার যাতে নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়: তারেক রহমান (ভিডিও) ◈ যৌথ বাহিনীর অভিযানে ময়মনসিংহে যুবদল নেতা নিহত 

প্রকাশিত : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ০৮:০৩ রাত
আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ০৪:৪৬ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

গণপিটুনিতে হত্যা, কেন বাড়ছে এই প্রবণতা? আইন কী বলে

এম এইচ বাচ্চু : গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। দুই দিনের ব্যবধানে তিন জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। কেন বার বার এইভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন সাধারণ নাগরিকরা? কেন বাড়ছে এই হত্যা প্রবণতা? জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক দলগুলোর কঠোর পদক্ষেপের অভাবেও কারণে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল এ কান্ড ঘটাছে, বলে মনে করেন অনেকে। 

দেশে গত সাড়ে ৬ বছরে গণপিটুনিতে ২৮৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডে মামলা হলেও শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। দেশে গণপিটুনিতে হত্যার অর্ধেক কাণ্ডই ঘটে ঢাকা বিভাগে। নির্বাচনের আগে-পরে বেড়ে যায় এসব ঘটনা।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় এসব ঘটনা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের উচিত হবে, এমন অপকর্মে দলীয় কর্মীদের বিরত থাকতে কঠোর বার্তা দেওয়া। 

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গণপিটুনিতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে মারধরের শিকার হয়েছেন সাবেক এক বিচারপতি। হজরত মুহম্মদ (স)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের দপ্তরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেই গণপিটুনির শিকার হন উৎসব মণ্ডল নামে এক তরুণ। 

বগুড়ায় মিজানুর রহমান মিজান নামে স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে। এদিকে মিজানের ওপর হামলার খবর পেয়ে এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে ছুটে আসে এবং ঘাতকদের ধাওয়া করে লেদু নামে একজন ধরা পড়লে গণপিটুনিতে সে মারা যায়।

রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) ইউটিউবার আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমকে বগুড়ার আদালত প্রাঙ্গণে কিলঘুষি মারার পর কান ধরে ওঠবস করানো হয়।

গত শনিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সদ্যোজাত সন্তান ও স্ত্রীর জন্য ওষুধ আনতে গিয়ে রাবির মেডিক্যাল সেন্টারের এ স্টোর অফিসার হামলার শিকার হয়েছিলেন।

এ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে এই সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ গণমাধ্যমকে বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মীদের সব ধরনের অপরাধ থেকে বিরত থাকার আহ্বান করছে। তাদের এসব আহ্বান আরও জোরালো হওয়া দরকার। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার জেরে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কঠোর বার্তা দিতে হবে। গণপিটুনির মতো অপরাধে অংশ নিলে আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো তার নেতাকর্মীদের বহিষ্কারসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশকেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, গত সাড়ে ৬ বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০১৮ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন, ঢাকায় নিহত হন ২১ জন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ৬৫ জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়, ঢাকায় নিহত হন ২২ জন। তবে ২০২০ সালে নিহতের সংখ্যা কমে ৩৫ জন হয়েছিল, ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৮ জন, ২০২২ সালে ৩৬ জন নিহত হন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর ২০২৩ সালে নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয় ৫১ জন। এর মধ্যে ঢাকাতেই ২৫ জন। ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর গত ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) গণপিটুনিতে নিহত হন ৩২ জন। ঢাকাতেই নিহত হন ১৬ জন।

মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশকেন্দ্রের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নূর খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, সমাজে এক ধরনের অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে কিংবা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি হচ্ছে বাংলাদেশে যেহেতু সবেমাত্র একটি স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটেছে, এখনো রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরোপুরি পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি। সুতরাং এ রকম একটা সময়ে দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ নিচ্ছে। তবে সরকারের উচিত শক্ত হাতে এসব বিষয় দমন করা এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

গণপিটুনির শিকার ভুক্তভোগীর স্বজনা বলছেন, গণপিটুনির ঘটনায় মামলা হলেও বিচার হওয়ার নজির নেই। বিচার যদি বিচারের মতোই হয়, তখন তাতে বার্তা থাকে। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে ঢাকার পাশেই আমিনবাজারের বড়দেশি গ্রামে ছয় ছাত্রকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পর আদালত ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে কারাদণ্ডের আদেশ দেন। কিন্তু এখনও মামলাটি আপিল আদালতে ঝুলে আছে। বিচার না হওয়ায় এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সহজভাবে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে মানুষ।

আইনে যা আছে: দেশের বর্তমানে কার্যকর সংবিধানের তৃতীয়ভাগে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। সংবিধানের ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভ, আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ, বিচার লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভ, অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, চোর ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। আর এর ব্যতিক্রম করলে দন্ডবিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী আপনাকে অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা পুলিশের আইনগত দায়িত্ব। আর এ দায়িত্বে বাধা দেয়ার মতো কোনো অধিকার আপনার নেই। বরং এমন কোনো ব্যক্তিকে আপনি যদি আটকে রাখেন এবং পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা দেন, তবে আপনাকে দন্ডবিধির ১৮৬ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০ টাকা জরিমানা বা দুই ধরনের দন্ডেই দন্ডিত হতে পারেন।

আটক রাখার পর যদি ওই ব্যক্তিকে পিটুনি বা ধোলাই দেন তবে কারাদন্ডে মেয়াদ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে অনূর্ধ্ব তিন বছর এক মাসে। সঙ্গে অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা তো থাকছেই। আঘাত করতে গিয়ে যদি গুরুতর আঘাত দিয়ে ফেলেন তবে ৩৩৪ ধারা দন্ডবিধি অনুযায়ী কারাদন্ডের মেয়াদ বাড়বে আরও এক বছর। আর অর্থদন্ড হবে অনূর্ধ্ব ২ হাজার টাকা। অবশ্য এ ক্ষেত্রেও কারাদন্ড ও অর্থদন্ড উভয় দন্ডেও দন্ডিত হতে পারেন। (দন্ডবিধি, ৩৩৫ ধারা)

যেই ব্যক্তির ওপর এভাবে আপনি হামলে পড়লেন তার মৃত্যু হলে, দন্ডবিধির ৩০৪ ধারার বিধান অনুযায়ী আপনার দশ বছর কারাদন্ড বা জরিমানা বা দুটি দন্ডই হতে পারে। আর যদি অপরাধীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মেরে ফেলার বিষয়টি প্রমাণিত হয় তবে দন্ড হল যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা অনূর্ধ্ব দশ বছর মেয়াদের যে কোনো কারাদন্ড। তার সঙ্গে যে কোনো পরিমাণ জরিমানা তো থাকছেই। (৩০৪ ধারা দন্ডবিধি, প্রথম অংশ)।

গণপিটুনিতে যদি ওই ব্যক্তি নিহত হয় তবে তার দায় বর্তাবে অপরাধ সংঘটনকারী সব ব্যক্তির ওপর। কেননা আইনে 'যৌথ দায়িত্বশীলতা' বলে একটি নীতি আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই অভিপ্রায় নিয়ে একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করলে, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন যেন তিনি নিজেই অপরাধটি করেছেন। তাই গণপিটুনিতে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে, সবাইকে সমভাবে এজন্য দায়ী করা যাবে। [৩৪ ধারা দন্ডবিধি]

কাজেই মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনায় জড়িত জনতার অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হলে সবারই ন্নূতম 'যাবজ্জীবন কারাদন্ড' হতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়