শিরোনাম
◈ জুলাই ফাউন্ডেশনে এলো ৩ প্রতারক, ধরা পড়ে গেলো জালিয়াতি! ভিডিও ◈ চাঁপাইনবাবগঞ্জে দু'টি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে  চালক নিহত   ◈ শিগগিরই নির্বাচনের ব্যাপারে আরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আসবে : অধ্যাপক আলী রীয়াজ ◈ রোহিত শর্মা অবসরে যাচ্ছেন না, খেলবেন ২০২৭ বিশ্বকাপ ক্রিকেট ◈ দুর্বল দলের বিরুদ্ধে কষ্টে জিতলো রিয়াল মাদ্রিদ ◈ বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় যুক্তরাজ্য: সারাহ কুক ◈ শিশুকে বিষ পান করিয়ে হত্যাকারী সেই সৎ মা গ্রেপ্তার ◈ মাধবপুরে এসএম স্পিনিং মিলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, দশ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি ◈ ময়মনসিংহে ট্রাক-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ৩ ◈ ইংলিশ লিগে চেলসির জয়, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-আর্সেনাল ড্র

প্রকাশিত : ০৩ জুন, ২০২২, ০৫:১৮ বিকাল
আপডেট : ০৩ জুন, ২০২২, ০৫:২০ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

শেরপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য

শেরপুর

তপু সরকার হারুন : ইতিহাস ঐতিহ্যের তীর্থভূমি শেরপুর। দশকাহনীয়া বাজুর এই শেরপুরে কোচ বিদ্রোহ, সন্ন্যাস বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, পাগল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, কৃষক-প্রজা আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধে রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

শেরপুর ভারতের মেঘালয়ের কোল ঘেঁষা ময়মনসিংহ বিভাগের একটি জেলা শেরপুর । জেলাটি ছোট হলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বলিত এ অঞ্চলে রয়েছে নানা ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থান। যা ভ্রমণ পিপাসুদের দৃষ্টি কাড়বে। মসজিদ, জমিদার বাড়ি, মন্দির ছাড়াও জেলাটিতে রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থান। এছাড়া অবকাশ কেন্দ্র, পাহাড়ে ঘেরা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ইকোপার্ক, রাজার পাহাড় ও বাবেলাকোনা, নয়াবাড়ির টিলা, পানিহাটা-তারানি পাহাড় ও সুতানাল দীঘি পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।

জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লিলাভূমি শেরপুর । ১৮২৯-২০১৫ পর্যন্ত জেলাটি ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা থেকে পৃথক হয়ে শেরপুর জেলা গঠিত হয়। যার আয়তন ১হাজার ৩৬৩ দশমিক ৭৬ বর্গকিলোমিটার ও বর্ত্ মান আদমশুমারি অনুসারে জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষর উপরে  ।

জানা যায়,  প্রাচীন কামরুপ রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের আদি নাম পাওয়া যায়নি। তবে এ অঞ্চলের হিন্দু শাসক দলিপ সামন্তের রাজ্যের রাজধানী গড়জরিপার নাম উল্লেখ আছে। সম্রাট আকবরের সময় এ অঞ্চলের নাম দশকাহনিয়া বাজু বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়।

১৮৬৯ সালে জমিদার আমলে শেরপুর পৌরসভা স্থাপিত হয়। সে সময় পৌরসভার দক্ষিণ সীমান্তে মৃগী নদী হতে জামালপুর ঘাট পর্যন্ত প্রায় ৮ থেকে ৯ মাইল প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব নাম ছিল লৌহিত্য সাগর। নদের উভয় পাড়ের নিকটবর্তী লোকদের প্রায় সময়ই নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। তারা খেয়া ঘাটের ইজারাদারের সহিত যাতায়াত মাশুল হিসেবে বাৎসরিক চুক্তি অনুযায়ী ১০ (দশ) কাহন কড়ি প্রদান করত। সে হিসেবেই এ অঞ্চলের নাম হয় দশকাহনিয়া।

তৎকালীন কড়ির মাধ্যমে বেচাকেনা বা আর্থিক লেনদেন করা হত। বাংলার নবাবী আমলে গাজী বংশের শেষ জমিদার শের আলী গাজী দশকাহনিয়া অঞ্চল দখল করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন। পরে এই শেরআলী গাজীর নামে দশকাহনিয়ার নাম হয় শেরপুর।

তখনও শেরপুর রাজ্যের রাজধানী ছিল গড়জরিপা। বর্তমান গাজীরখামার ইউনিয়নের গিদ্দা পাড়ায় ফকির বাড়িতে শের আলী গাজীর মাজার এবং নকলা উপজেলার রুনী গাঁয়ে গাজীর দরগাহ অবস্থিত। বৃটিশ আমলে এবং পাকিস্তান আমলে নাম হয় শেরপুর সার্কেল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেরপুরকে ৬১তম জেলা হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্লট পরিবর্তনে তা স্থগিত হয়ে যায়। পরে ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শেরপুরকে মহকুমা এবং ১৯৮৪ সালের ১২ ফেবরুয়ারি রাষ্ট্রপতি এরশাদ শেরপুরকে জেলায় উন্নীত করে জেলার ৫টি থানাকে উপজেলায় রুপান্তর করেন। যা শেরপুর সদর, নকলা, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলা হিসেবে।

আবার এসব উপজেলার নামকরণ হয়- শের আলী গাজীর নামানুসারে শেরপুর, নকলা গ্রামের নামানুসারে নকলা, অধিক পরিমাণ পাট উৎপাদনের সূত্রে নালিতাবাড়ি, সাধক সরওয়ার্দীর নামানুসারে শ্রীবরদী, ঝি ঝি পোকার গোঞ্জন থেকে ঝিনাইগাতি।

শেরপুরের সর্ব দক্ষিণের গ্রামের নাম ‘চরখার চর’। এক সময় এই গ্রামে চরখা দিয়ে সূতা তৈরি হতো। সেই জন্য গ্রামের নাম চরখার চর। চরখার চরের পাশে গ্রাম বেতমারী। এই গ্রামে আগে বেতের চাষ হতো। জঙ্গলে ঘেরা বা জঞ্জল থেকে জংগলদি। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী গ্রাম ছনকান্দা। নদীর তীরে প্রচুর ‘ছন’ চাষ হতো সে কারণে কান্দা বা টিলা উচুঁ জায়গার নাম হয় ছনকান্দা।

কোনো এক সময় বন্য হাতিকে ধরে গ্রামের মানুষ বেঁধে রেখেছিল বলে গ্রামের নাম হয়েছে হাতিবান্দা। তেমনি কোনো এক সময় গ্রামের মানুষেরা হরিণ ধরে রেখেছিল বলে গ্রামের নাম হয়েছে হরিণধরা। গ্রামের মসজিদে যিনি নামাজ পড়ান তাকে শেরপুরে মুন্সি বলা হয়।

দেখা যায় এই মুন্সি ব্যক্তিটি গ্রামের লোকদের কাছে খুব সম্মানিত হয় এবং বংশ পরম্পরায় মুন্সিদের কদর হয়। তাই গ্রামের এই প্রধান ব্যক্তিটির নামানুসারে যেমন বাড়ির নাম মুন্সিবাড়ি তেমনি গ্রামের নামও মুন্সিরচর হয়েছে।

শেরপুরের আরও কয়েকটি গ্রাম ও এলাকার নাম একইভাবে টেংরামারি, টাকিমারি, সাপমারী, ফটিয়ামারি, রৌহা, খুনুয়া, কুমড়ার চর, কামার চর, বলাইর চর, চরশাব্দী, চরসুচারিয়া, নলবাইদ, সাতপাইক্যা, ইলশা, লসনমপুর, কুসুমহাটি, টিকারচর, ডুবারচর, পাকুরিয়া, গাজীরখামার, কামারিয়া, আলিনাপাড়া, আন্ধারিয়া, সূর্যদি, ভাতশালা, ভীমগঞ্জ, বয়রা, নবীনগর, দীঘারপাড়, কালিগঞ্জ যোগিনিমুরা, বাজিতখিলা, হেরুয়া, ঘুঘুরাকান্দি, বারগড়িয়া, তারাকান্দি, কসবা।

ঐতিহ্যবাহী তথ্যজড়িত বিষয়গুলোর মধ্যে আছে বর্তমান শেরপুর পৌর এলাকার পশ্চিমাংশে একটি গ্রামের নাম কসবা। এর আরবি মূল শব্দ কসবাহ এবং এর অর্থ শহর হতে ছোট কিন্তু গ্রামের মধ্যে বড় সমৃদ্ধশালী গ্রাম। মোগল আমলে বাঙ্গলার সুবেদার শাহজাদা সুজা এ কসবাতেই তার আঞ্চলিক প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।

চারদিকে পরিখাবেষ্টিত মোগলবাড়ী, কাছারী পাড়া, তার পশ্চিমে কাঠগড়, তার উত্তর পশ্চিমে বিচারক কাজীদের বসতবাড়ি কাজী গলী, কাজী গলী মসজিদ, দরবেশ শাহ কামালের দরগাহ, ধোপা ঘাট, নাপিত বাড়ি নামের স্থানগুলোর মাধ্যমে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

তারও আগে বার ভূঁইয়া নেতা ঈসা খান হাজরাদীর কোচ রাজা লক্ষণ হাজোকে পরাজিত করে হাজারাদী দখল করেন এবং ব্রহ্মপুত্রের উজান পথে দশকাহনীয়া বাজু বা বর্তমান শেরপুরে আরও দুটি দুর্গ নির্মাণ করেন। রাজা লক্ষণ হাজো তার লোক-লস্করদের নিয়ে ভারতের বিহার প্রদেশের উত্তর পূর্বাংশে চলে যায় এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে।

তাদের নামেই এ অঞ্চলের নাম হয় কোচ বিহার। ঠিক সে সময়ই ঈশা খাঁর শক্তি বৃদ্ধির কাহিনী শুনে সম্রাট আকবর ঈশা খানকে দমন করার জন্য রাজপুত বীর সেনাপতি মানসিংহকে এ অঞ্চলে প্রেরণ করেন।

পল্লী অঞ্চল ও শহর অঞ্চলে মক্তব মাদ্রাসা, উচ্চ প্রাইমারি ও নিম্ন প্রাইমারি জুনিয়র মাদ্রাসা, মাইনর স্কুল, সাংস্কৃতিক টোল ছিল। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না। শেরপুরের নয়আনী জমিদারদের উদ্যোগে সর্ব প্রথম একটি মধ্য ইংরেজি স্কুল স্থাপন করা হয়।

১৮৮৭ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার জুবিলী উৎসব উপলক্ষে সে স্কুলটিকে হাইস্কুলে উন্নীত করা হয় এবং নাম রাখা হয় ভিক্টোরিয়া একাডেমি। আড়াই আনী ও পৌনে তিনআনী জমিদারদের উদ্যোগে ১৯১৮/১৯ সালে গোবিন্দ কুমার পিস মেমোরিয়াল (জি,কে,পি,এম) নামে আরও একটি স্কুল স্থাপিত হয়।

পাকিস্তান আমলে ১৯৪৯ সালে শেরপুর বালিকা বিদ্যালয়, ১৯৫৭ সালে সরকারি কৃষি প্রশিক্ষায়তন, ১৯৬৪ সালে শেরপুর কলেজ এর পরে এস.এম. মডেল স্কুল, প্রতি উপজেলায় হাইস্কুল, স্বাধীনতা উত্তরকালে শেরপুর মহিলা কলেজ, ডা. সেকান্দর আলী কলেজ, পলিটেকনিক স্কুল, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট, যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছাড়াও শেরপুর জেলার প্রতি উপজেলাগুলোতেও অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেরপুর তেরাবাজার জামিয়া সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসাটি জেলার বৃহত্তম কৌমি মাদ্রাসা। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার কারিকুলাম অনুসারে এতে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত শিক্ষাক্রম পরিচালিত হয়। প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে গড়জড়িপার বার দুয়ারী মসজিদ, মাইসাহেবার মসজিদ ও খরমপুর জামে মসজিদ দুটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রাচীন তিনটি মন্দিরের মধ্যে একটি শ্রী শ্রী রঘুনাথ জিউর মন্দির আড়াই আনী বাড়ীর মহিলা কলেজ সংলগ্ন অপর দুটি যথাক্রমে শ্রী শ্রী মা ভবতারা মন্দির নয়আনী বাজারে এবং শ্রী শ্রী প্যারিমোহন মন্দির তিন আনী বাড়ীর শেরপুর কলেজ সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত। শেরপুর রোটারি ক্লাব ও রেড ক্রিসেন্ট রোডে শনি মন্দিরটি অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ মন্দির হিসেবে শেরপুরে পরিচিত।

বর্তমানে শেরপুরে দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে- গজনী অবকাশ, মধুটিলা ইকোপার্ক, নেওয়াবাড়ি টিলা, শের আলী গাজীর মাজার, জরিপ শাহ এর মাজার, শাহ কামাল এর মাজার, বার দুয়ারী মসজিদ, ঘাগড়া লস্কর খান মসজিদ, মাইসাহেবা জামে মসজিদ, পানি হাটা দিঘী, নয়ানী বাজার নাট মন্দির, রঘুনাথ জিউর মন্দির, জিকে পাইলট স্কুল, গড়জরিপা কালিদহ গাং এর ডিঙি, নালিতাবাড়ি ও শ্রীবরদীর বিখ্যাত রাবারড্যাম প্রভৃতি।

প্রবীন সাংবাদিক  সুভাষ চন্দ বাদল  বলেন  , আড়াই আনী ও পৌনে তিনআনী জমিদারদের উদ্যোগে ১৯১৮/১৯ সালে গোবিন্দ কুমার পিস মেমোরিয়াল (জি,কে,পি,এম) নামে একটি স্কুল স্থাপিত হয়।

লেখক ও গবেষক ড. সুধাময় দাস বলেন, ১০ (দশ) কাহন কড়ি থেকে প্রথম দশকাহনিয়া হয়েছে। পরে শের আলী গাজীর নামনুসারেই শেরপুর নাম হয়। শেরপুরে কৃষক সমৃদ্ধ ও পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

প্রবীন নেত্রী জয় শ্রী দাস লক্ষী বলেন, দশকাহনিয়ার সময়ও শেরপুরে খেলাধুলায় বেশি হতো। এখনও আছে। শিক্ষাখাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। আগেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। তবে উচ্চ শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তি  বীরমুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আক্তারুজ্জআমান বলেন, ১৯৮৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি এরশাদ শেরপুরকে জেলায় উন্নীত করে জেলার ৫টি থানাকে উপজেলায় হিসেবে রুপান্তর করেন। যা এখনও এই অবস্থায় রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়