শিরোনাম
◈ প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক নববর্ষ উদযাপনের উদ্যোগ ◈ দুদকের অভিযোগের জবাবে যা বললেন টিউলিপ ◈ অনন্ত জলিলের দাবি মিথ্যা: প্রেস সচিব শফিকুল আলম ◈ পুলিশের সিগন্যাল অমান্য করে পালানোর সময় প্রাইভেট কারসহ ২ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার ◈ সীমানা প্রাচীর ভেঙে র‍্যাবের মাঠে বাস, ডোপ টেস্টে চালক ◈ ক্রিকেটার সেজে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা, বিমানবন্দরে আটক ১৫ বাংলাদেশি ◈ সরকারের হস্তক্ষেপে সৌদি আরবগামী ফ্লাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটের এয়ার টিকিটের মূল্য ৭৫% কমলো ◈ ব্রিটেনে সদ্য আসা হাজারো বাংলাদেশি অভিবাসন নিয়ে চিন্তায় ◈ ভুয়া নথিতে ভারতীয় পাসপোর্ট: কলকাতায় ৬৯ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে লুক আউট নোটিশের আবেদন ◈ ইসরায়েলি হামলায় ৪৮ ঘণ্টায় ৯৭০ জন নিহত

প্রকাশিত : ১৯ মার্চ, ২০২৫, ০৭:১৬ বিকাল
আপডেট : ২০ মার্চ, ২০২৫, ০৫:০০ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ : প্রতি কেজিতে বৃদ্ধি ২০ টাকা

ফয়সাল চৌধুরী : চাল উৎপাদনকারী জেলা কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে নতুন করে ঊর্ধুমুখী হচ্ছে মিনিকেট চালের দাম। কোনভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না মিনিকেট চালের দামে। জেলা প্রশাসন বলছে, তারা মিনিকেট চালের দাম কমানোর বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তবে বাজার পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা।

গত শুক্রবার মিলগেটে মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৮৪ টাকা দরে; যা ১ মার্চ ছিল ৭৭ টাকা। বুধবার কুষ্টিয়া পৌর বাজারে ২৫ কেজির বস্তা মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ২১৫০ টাকা দরে। অর্থাৎ প্রতি কেজি মিনিটের চালের বিক্রমূল্য দাঁড়িয়েছে ৮৬ টাকা দরে। অর্থাৎ গত দুই সপ্তাহে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ টাকা। যা গত বছর ১০ অক্টোবর প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম দাম ছিল ৬৬ টাকা দরে অর্থাৎ গত পাঁচ মাসে মিনিকেট চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রতি কেজি ২০ টাকা। এতে হতাশায় ভুগছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা, সেই সাথে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, মিলারদের কাছ থেকে বেশি দামে চাল কেনায় তাদেরকে বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। এদিকে মিলারদের  দাবি ধানের দাম বেশি থাকার কারণে ও চাহিদার তুলনায় মিনিকেট ধান পাওয়ায় যাচ্ছে না এ কারণে চালের বাজারে এর প্রভাব পড়ছে।

এদিকে সবচেয়ে বিপদে পড়েছে নিম্ন মধ্য আয়ের মানুষেরা। বড়বাজার ও বড়বাজারের চাল ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের চালের অন্যতম বড় মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর মিলগেটে দফায় দফায় পাইকারি দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি করা হচ্ছে ৮৫ থেকে ৮৬ টাকা কেজি। যে চাল দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৭৮ টাকা। তবে মোটা চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।

এদিকে হঠাৎ করে দফায় দফায় চালের দাম বাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। সংসারে বাড়তি খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ। অসাধু চালকল মালিকদের কারসাজি ঠেকাতে বাজারের প্রতি নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন ভোক্তারা। 

কুষ্টিয়া পৌর বাজারের চাল ব্যবসায়ীরা জানান, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কুষ্টিয়ায় পাইকারি ও খুচরা বাজারে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত  বেড়েছে। মিলগেটে কারণে অকারণে পাইকারি দাম বাড়ার কারণে খুচরা বাজারেও দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। মিনিকেট চালের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি করা হচ্ছে যা আমাদের ব্যবসা পরিচালনা ও টিকে থাকার জন্য বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। ধানের দাম বৃদ্ধি ও ধান সংকটের কারণে দাম বেড়েছে বলে দাবি করছেন চালকল মালিকরা। 

দুই সপ্তাহ আগে পাইকারি দাম ছিল ৭৬ টাকা কেজি, সেই চাল এখন ৮৫ টাকা কেজি। আমরা অর্ডার দিয়েও মিল গেট থেকে চাল কিনতে পারছি না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান বর্তমানে মিলগেটে মিনিকেট চালের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে।

এনএস রোডের ব্যবসায়ী জাহিদ জানান, বেচাকেনা নাই। কিন্তু দিন দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে  তাতে সংসার চালানো খুবই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে ।

কুষ্টিয়া পৌর বাজারের চাল ব্যবসায়ী তাইজাল হোসেন ও  ছরোয়ার হোসেন জানান, মূলত নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে কুষ্টিয়ার বাজারে সব ধরনের চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হয়। এই দাম বৃদ্ধি এখনো অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ গত দুই সপ্তাহ ধরে মিনিকেট চালের দাম প্রতি কেজি ৯ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।  কুষ্টিয়ার খাজানগরে চালের ক্রয় মূল্য বৃদ্ধি পাওয়াতে বাজারে চালের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে বলে তারা দাবি করেন।

খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খাজানগরে অটো রাইচ মিল আছে ৬৪টি। তবে এর মধ্যে অর্ধেক মিল প্রায় বন্ধ। এসব মিলে কী পরিমাণ ধান মজুত, তার প্রতিদিনের একটি হিসাব মিল মালিকেরা অফিসে পাঠান। সেই হিসাব ঠিক আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে খাদ্য পরিদর্শকেরা নিয়মিত মিল পরিদর্শন করেন।

খাদ্য বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে আরও জানা গেছে, গোল্ডেন অটো রাইচ মিলে ১ মার্চ মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৭৭ টাকায়, ৪ মার্চ ৭৮ টাকায়, ৭ মার্চ ৭৯ টাকায়, ৯ মার্চ ৮০ টাকা, আর ১৪ মার্চ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৮৪ টাকায়। খাজানগর মোকামে গোল্ডেন অটো রাইচ, সুবর্ণা অটো রাইচ, দেশ অ্যাগ্রো ফুড, জাফর অ্যাগ্রো ফুডের মতো বড় কিছু প্রতিষ্ঠান দাম বেশি বাড়িয়েছে।

কুষ্টিয়া জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক আল ওয়াজিউর রহমান জানান, অন্যান্য ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের দামের থেকে দেশ এগ্রো ও গোল্ডেন রাইস মিলের মিনিকেট চালের দাম প্রায় ১০ থেকে ১১ টাকা বেশি। ১৮ মার্চ বড়বাজারে প্রতি বস্তা দেশে এগ্রো মিনিটের চালের দাম ছিল ২০৫০ টাকা , গোল্ডেন ব্র্যান্ডের মিনিকেটের প্রতি বস্তা দাম ছিল ২১০০ টাকা। কিন্তু অন্যান্য ব্র্যান্ডের প্রতি বস্তা মিনিকেটের দাম ছিল ১৮৭০ টাকা। এদিকে সবচেয়ে ভালো মনের মিনিটে ধানের দাম প্রতি কেজি ৫৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। হঠাৎ চালের বাজার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছে কিনা কেউ সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। 

এদিকে চালের দাম বাড়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে খাজানগরের বড় যে ১৫ থেকে ২০টি মিল আছে, সেখানে বারবার অভিযান পরিচালনা ও মজুত খতিয়ে দেখছে খাদ্য বিভাগ।

মিলমালিক ও খাদ্য অফিসের তথ্যমতে আরো জানা গেছে, ৩ ড্রায়ারের একটি অটো রাইচ মিলে ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৩ হাজার ৬০০ মণ ধানের প্রয়োজন পড়ে। ১টি ড্রায়ার চালাতে ২৪ ঘণ্টায় ৬০০ মণ ধানের প্রয়োজন পড়ে। ৩ হাজার ৬০০ মণ ধান থেকে চাল উৎপাদন হয় ২ হাজার ৩৪০ মণ। অর্থাৎ ১ মণে ২৬ কেজি চাল উৎপাদন হয়। স্বাভাবিক সময়ে একটি মিলে ৩ হাজার টন থেকে ৪ হাজার ৫০০ টন পর্যন্ত চাল মজুত থাকে। এখন সেখানে মজুত আছে ৩৬০ টন থেকে ৪০০ টন পর্যন্ত।

খাজানগরের চালকল মালিক দাদা রাইসের কর্ণধার আরশাদ আলী বলেন, বর্তমানে ধানের দাম আকাশছোঁয়া। তারা এখন মিনিকেট ভালো মানের প্রতিমণ ধান কিনছেন প্রায় ২ হাজার ৩ শত টাকায়। সরু জাতের ধান যেসব কৃষকের ঘরে আছে, তারা বেশি দাম ছাড়া বিক্রি করছেন না। এসব কারণে চালের দাম বাড়াতে হচ্ছে। মিল মালিকরা কম দামে কিনতে পারলে ভোক্তারাও কম দামে চাল পাবে।

চালকল মালিকদের মজুতদারি ও সিন্ডিকেট তৈরির অভিযোগ প্রসঙ্গে আরশাদ আলী বলেন, অটো মিল চালাতে প্রচুর ধানের প্রয়োজন হয়। এ কারণে মিল মালিকরা ১৫ দিনের ধান মজুত রাখেন। খাদ্য অফিসে নিয়মিত মজুতের পরিমাণ জানিয়ে হালনাগাদ তথ্য পাঠাতে হয়। মিল মালিকদের বাড়তি ধান মজুত করার কোনো সুযোগ নেই। বিদেশ থেকে চাল আমদানির পাশাপাশি সরকারিভাবে খোলা বাজারে কম দামে চাল বিক্রির আওতা বাড়ালে বাজারে দাম কমে আসবে বলে মনে করেন এই মিল মালিক।

বাংলাদেশ অটোর মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিলমালিক সমিতির কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, খাজানগর মোকামে স্বাভাবিক সময়ের তুলনা একেবারেই মজুত কম। মিলে ধান ও চালের মজুত থাকলে বাজার স্বাভাবিক থাকে।  জয়নাল আবেদিন আরও বলেন, গত শনিবার উত্তরবঙ্গের কয়েকজন মিলমালিকের কাছ থেকে তাঁরা ধান কিনেছেন ২ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে। গত সপ্তাহেও সরু ধানের এই বাজারদর ছিল ১ হাজার ৯০০ টাকা। এছাড়াও এই মুহূর্তে ফরিয়া ও কৃষকদের ঘরে কোনো সরু ধান নেই । উত্তরবঙ্গের অনেক মিলমালিকের কাছে কিছু ধান মজুত আছে। তাঁরা বেশি দামে বিক্রি করছেন। 

গোল্ডেন অটো রাইচ মিলের মালিক জিহাদুজ্জামান জিকু বলেন, ‘আমার মিলে প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০ ট্রাক ধান লাগে। সেখানে বুধবার ধান পেয়েছি মাত্র তিন ট্রাক। মিল বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নাই।’

খাজানগর এলাকার সবচেয়ে বড় চাল ব্যবসায়ী দেশ অ্যাগ্রো ফুডের স্বত্বাধিকারী আবদুল খালেক বলেন, ‘বড় বড় আটটি করপোরেট কোম্পানি রয়েছে, বাজারে ধানের দাম তারাই বাড়াচ্ছে।  তাছাড়া দেশে যে বন্যা হয়ে গেছে, তাতে ধানের উৎপাদন তেমন হয়নি। এমনকি বর্তমানে ধানের দামও বেশি। এ জন্য চালের দাম বাড়াতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন।’ এই ব্যবসায়ী আরও দাবি করেন, বাজারে এখন মিনিকেট ধানও নেই। প্রতিদিন আমার মিলে যে চাহিদা তার ২৫ শতাংশ ধান পাচ্ছি না। অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ চাহিদা অনুযায়ী ধান পাচ্ছি না এছাড়াও বর্তমানে প্রতি মন মিনিকেট ধান ২২০০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। 

 অন্যান্য ব্যান্ডের মিনিকেট চালের দাম থেকে আপনাদের চালের দাম প্রতি কেজি ১০ থেকে ১১ টাকা বেশি কেন এত বেশি এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, আমাদের চালের গুণগত মান অন্যান্য ব্রান্ডের থেকে অনেক ভালো এজন্য দামটাও বেশি।

এদিকে বুধবার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে,  প্রকারভেদে কুমারখালীত ও খোকসায় মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ থেকে ৮৪ টাকা কেজি দরে। ভেড়ামারা উপজেলায় ৭৪ থেকে ৭৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিরপুর উপজেলায় মিনিকেট চাউল খুচরা বাজারে টাকা ৭৮ দরে বিক্রি হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করা সত্ত্বে প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দ্রুত যোগাযোগ করে দিনের শুরুতে চালের দাম নির্ধারণ করে থাকেন মিলমালিকেরা। এমন বিষয় জেলা প্রশাসকও অবগত রয়েছেন। এমনকি করপোরেট ব্যবসায়ীদের কাছে জেলার কয়েকজন মিলমালিক যোগসাজশ করে চাল তাঁদের কাছে সরবরাহ করার তথ্যও রয়েছে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কুষ্টিয়া কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সুফি মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান বলেন, বাজারে কোন ধানেরই ঘাটতি নাই, এক শ্রেণী অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এর মাধ্যমে কারণে অকারণে চালের দাম বৃদ্ধি করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়