শিরোনাম

প্রকাশিত : ১৪ মার্চ, ২০২৫, ০৯:১৫ রাত
আপডেট : ১৫ মার্চ, ২০২৫, ০১:৪৫ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ভারত ফেরার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হলো কারাবন্দী বিজলির: ততক্ষণে তিনি আর বেঁচে নেই, অবশেষে গেল লাশ

দুই দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে হস্তান্তর করা হয় বিজলি রায়ের লাশ। শুক্রবার বিকেল সাড়ে তিনটায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে

২০২১ সালের মে-জুনের দিকে শরীয়তপুরে আটক হন ভারতের নাগরিক বিজলি রায়। অনুপ্রবেশের দায়ে জাজিরা থানায় মামলা হয়। বিচারে দেওয়া হয় ছয় মাসের জেল। সাজা খাটতে তাঁকে পাঠানো হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ কারাগারে। সাজা শেষে তাঁকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল বিজিবি; কিন্তু বৈধ অভিভাবকের খোঁজ না পাওয়ায় সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। খবর প্রথম আলো।

নানা ঘটনার পর যখন মানসিক ভারসাম্যহীন বিজলি রায়ের (৪০) বাড়ি ফেরার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হলো, ততক্ষণে তিনি আর বেঁচে নেই। দুই মাস রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হিমঘরে থাকার পর অবশেষে তাঁর প্রাণহীন দেহ দেশে পাঠানো হলো। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আজ শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁর মরদেহ হস্তান্তর করা হয় বলে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন রাজশাহীর সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায়।

বিজলিদের বাড়ি ভারতের বিহার রাজ্যের মোজাফফরপুর জেলার মিনাপুর থানার চক জামাল গ্রামে। তাঁর এই ঠিকানা খুঁজে বের করে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেছিলেন বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলের জ্যেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক শামসুল হুদা। তাঁর প্রচেষ্টাতেই মৃত্যুর পর হলেও বাড়ি ফিরছেন বিজলি রায়।

এর আগেও এমন আটকে পড়া মানুষদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন শামসুল হুদা। এ ধরনের আটকে পড়া মানুষকে নিজ ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া তাঁর নেশা। তিনি এ পর্যন্ত বাংলাদেশ–ভারতের কারাগারে আটকে থাকা ৪৩ ব্যক্তিকে পরিবারের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন বলে জানান। তাঁকে নিয়ে ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

বিজলি রায়কে বাড়ি ফেরানোর রুদ্ধশ্বাস কাহিনি শোনালেন সাংবাদিক শামসুল হুদা। তিনি জানান, তাঁর এ ধরনের উদ্যোগের কথা চুয়াডাঙ্গার জেল সুপারের মাধ্যমে জানতে পারেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেল সুপার। তিনি শামসুল হুদাকে ভারতের বন্দী ১১ জনের একটি তালিকা পাঠান। এর মধ্যে ছয়জনকে পরিবারের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। এরপর শুরু করেন বিজলি রায়কে ফেরানোর কাজ।

শামসুল হুদা বলেন, বিজলি রায়ের নথিপত্রে রাজ্য ও থানার নাম ঠিক ছিল; কিন্তু গ্রাম ও পোস্ট অফিসের নাম ভুল ছিল। গ্রামের নাম ছিল ‘জেমাল’। তিনি মিনাপুর থানায় যোগাযোগ করেন। এরপর ‘জেমাল’ নামের কাছাকাছি কোন কোন গ্রামের নাম রয়েছে সেগুলো খুঁজে দেখার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে পেয়ে যান চক জামাল গ্রামের নাম। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বিজলির পরিবারের সন্ধান দেয়। ২৯ ডিসেম্বর বিজলি রায়ের যাবতীয় অফিশিয়াল নথি ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসে ই–মেইল করে পাঠানো হয়।

এরপর বিজলির ভাই বদ্রি রায় মাঝেমধ্যেই ফোন করে খোঁজখবর নিতেন বলে জানান শামসুল হুদা। তিনি জানান, বেশ কয়েকবার তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন; কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা থাকায় সরাসরি তাঁর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁকে দেখতে কেমন, এ রকম কয়েকটি ছবি বদ্রি রায়কে পাঠানো হয়েছিল।

শামসুল হুদা বলেন, গত ১৫ জানুয়ারির বদ্রি রায় ফোনে জানান, বাংলাদেশ থেকে কেউ একজন তাঁকে ফোন করেছিলেন। সেই নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করলে জানতে পারেন রাজশাহী জেলা কারাগারের জেল সুপারের। জেল সুপার তখন তাঁকে বলেন, ‘ভাই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, বিজলি রায় গত চার দিন আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অসুস্থ অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আজ (১৫ জানুয়ারি) তাঁর মৃত্যু হয়েছে, আমি ফোন দিয়েছিলাম; কিন্তু ভাষাগত সমস্যার কারণে বলতে পারিনি।’

জীবিত বিজলিকে বাড়ি ফেরানোর লড়াই সেখানেই শেষ হয়। তবে শামসুল হুদা বিজলির মরদেহ পরিবারের কাছে পৌঁছাতে আরেক লড়াইয়ে নামেন। তাৎক্ষণিক ভারতীয় দূতাবাসে বিষয়টি জানান। পাশাপাশি রাজশাহী জেলারকে মৃত্যুর বিষয়টি কারা অধিদপ্তরের মাধ্যমে হাইকমিশনকে অবহিত করারও অনুরোধ জানান। ১৬ জানুয়ারি সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায় চিঠিতে কারা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে অবহিত করেন। এরপর কারা মহাপরিদর্শক দপ্তর থেকে বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘুরে চিঠিটি দূতাবাস কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো হয়।

ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃপক্ষ গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিজলি রায়ের মরদেহটি পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারি পরিপত্র জারি করে। দূতাবাসের পাঠানো চিঠিটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘুরে কারা অধিদপ্তরের কাছে দ্রুততার সঙ্গে পৌঁছানোর জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকেন শামসুল হুদা। তিনি জানান, অবশেষে ৩ মার্চ হাইকমিশন থেকে পাওয়া চিঠিটি কারা অধিদপ্তরে পাঠানো হলে তার ভিত্তিতে বিজলি রায়ের মরদেহের ছাড়পত্র রাজশাহী জেলা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

শামসুল হুদা বলেন, পরদিন বিষয়টি নিয়ে তিনি রাজশাহী জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষের ডেপুটি জেলার হানিফ আহমেদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেন। ডেপুটি জেলার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। এরপর বিজিবির রাজশাহী বিভাগের ৫৯ ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের মাধ্যমে মরদেহ হস্তান্তরের তারিখ নির্ধারণ করার লক্ষ্যে দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর প্রধানকে চিঠি পাঠানো হয়। ইতিমধ্যে ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃপক্ষ মৃতদেহটি রাজশাহী থেকে বিহারের মোজাফফরপুর জেলার মিনাপুরে পৌঁছানোর জন্য দুই দিকে দুটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে রাখে। তারপর শুরু হয় অপেক্ষা। অবশেষে বিএসএফের কাছ থেকে তারিখ পাওয়ায় শুক্রবার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।

রাজশাহীর সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায় প্রথম আলোকে বলেন, সব প্রক্রিয়া শেষ করে শুক্রবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হিমঘর থেকে বিজলির মরদেহ বের করা হয়। সকাল পৌনে আটটায় তাঁকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে যায়। জেলার মৃতদেহটি মিলিয়ে দেখেন। তারপর সাড়ে আটটায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের উদ্দেশে রওনা দেয়। সেখানে বেলা ১১টায় লাশ হস্তান্তরের সময় থাকলেও সব প্রক্রিয়া শেষে বেলা সাড়ে তিনটায় লাশ হস্তান্তর করা হয়।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়