শিরোনাম

প্রকাশিত : ০৭ মার্চ, ২০২৫, ০২:০৫ রাত
আপডেট : ০৭ মার্চ, ২০২৫, ০৩:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কুমিল্লা জেলাজুড়ে অবাধে চলছে ফসলি জমির মাটি কাটার হিড়িক

শাহাজাদা এমরান,কুমিল্লা : কুমিল্লা জেলাজুড়ে অবাধে চলছে ফসলি জমির মাটি কাটার হিড়িক। ইটভাটা মালিকদের আর্থিক প্রলোভনে মাটি বিক্রির সর্বনাশা কাজে মেতেছে মুনাফালোভী ভূমি মালিক ও কৃষক। এতে একদিকে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে ফসলি জমি, অপরদিকে মাটির উর্বরতা কমে অনাবাদি হচ্ছে শত শত হেক্টর কৃষিজমি। আর এসব মাটি পরিবহনে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে গ্রামীণ রাস্তাঘাট। শুকনো মৌসুমে ধুলাবালিতে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।

সর্বশেষ গত বছর জেলার মুরাদনগরে জমি কাটায় বাধা দেওয়ায় প্রাণ হারাতে হয়েছে এক ব্যক্তি। তার নাম আবদুল বারেক ওরফে খোকন মিয়া। তিনি মুরাদনগর উপজেলার বকুলনগর গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে। এর আগে জেলার লাকসামে ড্রেজার মেশিনে মাটি কাটা বন্ধ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছিলেন ভূমি অফিসের কর্মকর্তাসহ তিনজন। প্রশাসনের অভিযান, স্থানীয়দের বাধা পরও জেলাজুড়ে কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না ফসলি জমির মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা।

জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লা জেলায় এক লাখ ৯৫ হাজার হেক্টর আবাদি জমি ছিল। গত তিন বছরে ৪০০ হেক্টর আবাদি জমি হ্রাস পেয়েছে। এর মূল কারণ হিসেবে ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে নেওয়াকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিন জেলার সদর উপজেলা, চান্দিনা, দেবীদ্বার, বুড়িচং, লালমাই, বরুড়া, চৌদ্দগ্রাম, মুরাদনগরসহ বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ফসলি জমির মাটি কেটে ওই মাটি স্থানীয় ইটভাটাগুলোর জোগান দিচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও ড্রেজিং করে ফসলি জমির মাটি দিয়ে বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়তে ভরাটের কাজ চলছে। স্থানীয় প্রশাসন মাঝেমধ্যে ২-৪টি অভিযান চলানোর ফলে কোথাও কয়েক দিন বন্ধ থাকে আবার কোথাও প্রশাসনের গাড়িবহর চলে গেলে পুরোনো চিত্রে ফিরে আসে ওই মাটিখেঁকো শ্রেণি-পেশার মানুষ। আবার কোথাও কোথাও স্থানীয়দের রোষানলে পড়তে হচ্ছে খোদ প্রশাসন কর্মকর্তাদের। গত রবিবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে লাকসাম পৌরসভার গাজিমুড়া দক্ষিণপাড়া মাঠে অবৈধ ড্রেজার মেশিনে বাধা দেওয়ায় ভূমি অফিসের তিন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কুপিয়ে আহত করেছে ভূমিদস্যুরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুমিল্লা জেলার ১৭টি উপজেলায় প্রায় আড়াইশ ইটভাটা রয়েছে। বাংলা বর্ষপঞ্জিকার কার্তিক মাসের শুরু থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রায় ৬ মাস মাটি পরিবহন ও ইট তৈরির কাজ চালিয়ে আসছে ইটভাটার মালিকরা। ওইসব ইটভাটায় সারা বছরের মাটি জোগান দিচ্ছে এ জেলার কৃষিজমি ও অরক্ষিত ‘গোমতী’ নদীর সুবিশাল চর। মৌসুমজুড়ে ইটভাটায় মাটি সরবরাহে ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রলিযুক্ত অবৈধ ট্রাক্টর ও ড্রাম ট্রাক। আর ভারি যানবাহনের চাকায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো যেন বালুময়।

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কৃষকদের অভিযোগ, প্রতিনিয়ত রাতের আঁধারে কৃষিজমি ও গোমতী নদীর মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটায়। এ বিষয়ে বহুবার জমির মালিকদের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। ফলে উপজেলার বেশ কয়েকটি জায়গার খালের পানি নিষ্কাশন বন্ধ করে ড্রাইভেশন তৈরি করে বেপরোয়াভাবে দিনে-রাতে কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটায়।

জেলার চান্দিনা উপজেলার পানিপাড়া এলাকার স্কুলছাত্রী ফাহমিদা আক্তার জানান, আমাদের গ্রামে কয়েকটি ইটভাটা রয়েছে। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত অবধি চলছে মাটির গাড়ি। কাদামাটি পাকা রাস্তায় পড়ে বিভিন্ন স্থানে পিচঢালা রাস্তাও দেখা যাচ্ছে না। আর মাটির রাস্তাগুলোর ধুলাতে পা দেবে যায়। একদিন স্কুল থেকে এলেই ড্রেস ময়লা হয়ে যাচ্ছে, এমনকি মাস্ক বা নেকাবের ভেতরেও ধুলাবালি প্রবেশ করছে। আমরা এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চাই।

বুড়িচং উপজেলার মোকাম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. সাহেব আলী জানান, মোকাম ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ফসলি জমি ও জলাশয়ে অবৈধ ড্রেজার মেশিন বসিয়ে কৃষিজমি থেকে গভীর গর্ত করে মাটি উত্তোলনের ফলে ফসল ও জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগ এলাকার অসংখ্য কৃষক করে আসছে। কৃষক ও ফসল বাঁচাতে আমি ড্রেজার মেশিন জব্দ করেছি। কৃষকদের বৃহত্তর স্বার্থে আমি এলাকায় এ ধরনের অভিযান অব্যাহত রাখব।

কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. মুজিবুর রহমান জানান, ধুলাবালিতে নানা জীবাণু মানবদেহের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও ক্যানসার থেকে শুরু করে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটছে বায়ুদূষণের ফলে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে বাংলাদেশেও বায়ুদূষণে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এই বায়ুদূষণে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় সচেতন মহলকেও আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আইয়ুব জানান, কৃষিজমি থেকে ওপরের মাটি কেটে দস্যুরা শুধু মাটিই নিচ্ছে না, কেটে নিচ্ছে কৃষির হৃৎপিন্ড। যেসব জমির টপ সয়েল কেটে নেওয়া হচ্ছে ওইসব জমিতে উর্বরতা আবার আগের অবস্থায় আসতে ২০-৫০ বছর সময় লাগে। অনেক মুনাফালোভী কৃষক রয়েছেন, যারা মনে করছেন ওপরের ২-১ ফুট মাটি বিক্রি করে কিছু টাকা পাবেন জমি তো রয়েই যাবে, তারা জমির টপ সয়েলের গুরুত্ব বোঝেন না। আবার কিছু দালাল রয়েছে তারা লেখাপড়া না জানা বা স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন কৃষকদের ভুল বুঝিয়ে বাগিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের স্বার্থ। জমির টপ সয়েল কেটে নেওয়া বন্ধ করতে আমরা জেলা সমন্বয় সভায়ও আলোচনা করেছি। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়