বছরের পর বছর ভারতীয় চিকিৎসকরা বিনা অনুমতিতে রোগী দেখছে বাংলাদেশে। কেউ আসছে টেকনোলজি ট্রান্সফারের (প্রযুক্তি হস্তান্তর) বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের অনুমতি নিয়ে, আবার কেউ আসছেন ভিজিট ভিসায়। তারা সবাই বাংলাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ও চেম্বারে বছরের পর বছর রোগী দেখে এবং অস্ত্রোপচার করে এ দেশের কষ্টার্জিত ডলার ভারত নিয়ে যাচ্ছেন। এমন ঘটনাও আছে, কেউ কেউ টানা ১২ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে ব্যবসা করে গেছেন। চিকিৎসায় প্রযুক্তি হস্তান্তর আপাত দৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও অভিযোগ রয়েছে, তাদের অনেকেই অস্ত্রোপচার করে কোটি কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে ভারত নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ডাক্তারদের প্রশিক্ষিত না করেই।
জানা গেছে, নন্দ কুমার নামে এক ভারতীয় চিকিৎসক বাংলাদেশে টানা ১২ বছর কাটিয়ে গেছেন। এই চিকিৎসক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার প্রভাব ব্যবহার করে ১২ বছর বাংলাদেশে অবস্থান করে ডলার নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভারতীয় চিকিৎসকরা রোগী দেখে ও অস্ত্রোপচার করে কাটিয়ে দিচ্ছেন, তারা চিকিৎসা প্রযুক্তি হস্তান্তর করছেন না। বাংলাদেশের নামী-দামি হাসপাতালগুলোতেই প্রযুক্তি হস্তান্তরের নামে বেশি ভারতীয় চিকিৎসক আসেন। এতে যেমন ভারতীয়রাও এখান থেকে যথেচ্ছ ডলার কামিয়ে নিয়ে যান, আবার বাংলাদেশের হাসপাতালগুলো ভারতীয়দের মাধ্যমে কামাই করে নিচ্ছে।
বিএমডিসির একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ১৫ জন ভারতীয় চিকিৎসক বাংলাদেশের কয়েকটি হাসপাতালে বৈধ অনুমতি নিয়ে আছেন। এই তথ্য ছাড়া আর কোনো তথ্য বিএমডিসি থেকে পাওয়া যায়নি। ওই সূত্রটি জানিয়েছেন, যে চিকিৎসকরা বৈধভাবে বাংলাদেশে এসেছেন, তাদের তথ্যই বিএমডিসির কাছে আছে। এর বাইরে শতাধিক ভারতীয় চিকিৎসক বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করে টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশের অর্থোপেডিক্স কিডনি প্রতিস্থাপনে দক্ষ এমন কয়েকজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চিকিৎসা প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে কোনো বিদেশী চিকিৎসককে তিন বছর থাকতে হয় না। সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ দিলেই বাংলাদেশের চিকিৎসকরা দক্ষ হয়ে উঠেন। বাংলাদেশের একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে দেখা যায় তারা প্রায় প্রতি বছর ভারতীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বাংলাদেশে নিয়ে আসেন মাত্র এক সপ্তাহের জন্য। এই এক সপ্তাহেই ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষ চিকিৎসাটি শিখতে পারছেন। দেখা গেছে, ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রায় প্রতি বছরই ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসেন নতুন নতুন বিষয়ে চিকিৎসা প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য। এতে করে ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখন স্পেশালাইজড চিকিৎসার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠেছে।
বিদেশী চিকিৎসকদের ব্যাপারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা: রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে ভারতের পোষ্য সরকারের পতনের পর থেকে আমাদের জন্য চিকিৎসাসহ সব ধরনের ভিসা স্থগিত রেখেছে। অথচ বিএমডিসির অনুমতি ছাড়াই ভারতীয় চিকিৎসকরা বাংলাদেশে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। জনগণের আন্দোলনের ফসল যে সরকার, সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো নজরই দিচ্ছে না বিষয়টি নিয়ে।’ গতকাল বুধবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে বগুড়া শহরে গুলিবিদ্ধ বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদল সদস্য মুশফিক রহমান সোহাগের চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হবার পর থেকেই তারেক রহমানের আর্থিক সহযোগিতায় মুশফিকের চিকিৎসা চলছে। মুশফিক বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন।
ভারতীয় চিকিৎসকরা বাংলাদেশে কীভাবে চিকিৎসায় নিয়োজিত আছেন এ প্রশ্নের জবাবে বিএমডিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েকজন ভারতীয় চিকিৎসক বাংলাদেশের কয়েকটি হাসপাতালে আছেন টেকনোলজি ট্রান্সফারের উদ্দেশ্যে। টেকনোলজি ট্রান্সফারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট চিকিৎসককে তাদের হাসপাতালে কাজ করার জন্য অনুমতি নিয়ে থাকেন। সাধারণত তিন বছরের জন্য বিদেশী চিকিৎসকদের অনুমতি দেয়া হয়। তবে এক বছর পরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিএমডিসিতে বিদেশী চিকিৎসকদের টেকনোলজি ট্রান্সফারের অগ্রগতিবিষয়ক রিপোর্ট করতে হয়। এর বাইরে অন্য কেউ বাংলাদেশে চিকিৎসায় নিয়োজিত আছেন কি না- তা বিএমডিসির জানা নেই।’
চিকিৎসা বিষয়ে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভিসি অধ্যাপক ডা: মো: শাহীনুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশেই প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন, এখানেই সব ধরনের উন্নত চিকিৎসা হচ্ছে। রোগীদের যেন বিদেশ যেতে না হয় সে ব্যাপারে বিএসএমএমইউ প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির কাজ করে যাচ্ছে।’
উল্লেখ্য, প্রতি বছর বিদেশে চিকিৎসা নিতে বাংলাদেশ থেকে ৫০০ কোটি ডলার চলে যাচ্ছে। এর বেশির ভাগই যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা বলছেন, এ দেশেই সব ধরনের চিকিৎসা আছে। কাউকে বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন নেই চিকিৎসা খাতে। নয়া দিগন্ত
আপনার মতামত লিখুন :