জাহাঙ্গীর লিটন, লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরের মেঘনার দুর্গম চরাঞ্চলে কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে। আগে যেখানে শুধুমাত্র হাতেগোনা কয়েকটি ফসল চাষাবাদ হতো, সেখানে এখন সবজিসহ প্রায় সব ধরণের ফসল চাষ হচ্ছে। অনেক অনাবাদি জমি এসেছে চাষের আওতায়। কৃষিতে নির্ভর করেই গত ২০ বছর থেকে স্বপ্ন বুনছেন নদী ভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করা চরের মানুষ।
সরেজমিনে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়নের মজুচৌধুরীর হাট লঞ্চঘাট থেকে পশ্চিমে নদীর মাঝখানে অবস্থিত চরমেঘায় দেখা যায়, পূর্বে পরিত্যক্ত ও গোচারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত এ চরটি এখন সোনালী ফসলে দোল খাচ্ছে। হাতছানি দিচ্ছে কৃষি বিপ্লবের। প্রায় ২০ বছর ধরে স্থানীয় কৃষকেরা চরের উর্বর পলিতে সোনালী ফসল উৎপাদন করে আসছে। প্রথমদিকে এখানে সবচেয়ে বেশি সয়াবিন উৎপাদন হতো, এরপর ধান। কিন্তু এখন ধান, সয়াবিন, শসা, করলাসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি ফলিয়ে আসছেন কৃষকরা। বছরের ৬ মাস এ চরে চাষাবাদ নিয়ে ব্যস্ত থাকে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকরা। এখানে উৎপাদিত প্রায় ৯০ শতাংশ সবজি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। স্থানীয়দের কাছে এ চর যেমন একদিকে কৃষি বিপ্লব হাতছানি দিচ্ছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানের জন্যও উর্বর ভূমি হিসেবে পরিচিত।
কৃষকদের অভিযোগ- কৃষি বিভাগ থেকে কোন সহযোগীতা তো দূরের কথা- পরামর্শও পান না তারা। সংশ্লিষ্ট কেউ কখনো আসেও না তাদের কাছে। এখানকার উৎপাদিত ফসলের হিসেবও কখনো নেয়নি। তারা নিজেরাই নানান সংকট মোকাবেলার চেষ্টা করে। লাভের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে ক্ষতির শিকার হতে হয়। আর কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণে বেপারিদের বেধে দেওয়া মূল্যের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় তাদের। এতে অনেকাংশে নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় তারা। এরমধ্যেও কৃষকদের দাবি, সংশ্লিষ্টদের সু-নজর পেলে চরের মাটিতে কৃষিতে আরও বিপ্লব ঘটানো যাবে।
কৃষক জামাল হোসেন বলেন, এ চরে ধানের পাশাপাশি শসা, খিরা, করলা, লাউ, কুমড়া, চিচিঙ্গা ও তরীসহ নানান জাতের সবজির ভাল উৎপাদন হয়। বাণিজ্যিক চাষাবাদে মোটা অংকের অর্থের প্রয়োজন হয়। সবসময় টাকা পকেটে রাখতে হয়। কিন্তু আমরা কোন ঋণ পাই না। সঠিক মতো চাষাবাদ করতে পারলে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পড়লে ভাল লাভ হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে হয়। গেল মাসে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে অন্তত ৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে কৃষি অফিসাররা আছে কি না তা আমি জানি না। গত ৩ বছরে আমি কাউকে দেখিনি।
কৃষক আবু তাহের বলেন, ঝড়বৃষ্টি বা জোয়ার উঠলে কিছুটা ক্ষতির মধ্যে পড়তে হয়। আবার নতুন করে চাষাবাদ করি। তবে সব মিলিয়ে লাভও হয়। এছাড়া কখনো কেউ আমাদের দুইটা সার ও অথবা দুইটা বীজ কখনো দেয়নি।
চরের কৃষি শ্রমিক রিয়াজ, ফরিদা বেগম ও নাছরিন বলেন, চরের চাষাবাদ শুরুর পর থেকে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বছরের ছয় মাস চরে কাজ থাকে। আমরা মাসিক ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে নিয়োজিত আছি। চরেই থাকি, চরেই কাজকর্ম করি।
কৃষক মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, চরের মাটির গুণাগুণ ভালো। তাই ফলন ভালো হয়। ১৫ বছর ধরে চরে ধান, সয়াবিন, সবজির চাষ করি। তবে মাঝেমধ্যে অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে চরের ফসল তলিয়ে যায়। তখন ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। এ ক্ষতি থেকে কাটিয়ে উঠতে আমরা সরকারি কোন সহযোগিতা পাই না।
স্থানীয় কলেজ শিক্ষার্থী মো. জিহাদ হোসেন বলেন, চরের ফসল স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে যাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনে চরের জমি এবং কৃষকেরা ভূমিকা রাখছে। কিন্তু কৃষিপণ্য বাজারজাতের ক্ষেত্রে কৃষকদের ঠকতে হয়। তারা নায্যমূল্য পায় না। পণ্য বাজারজাতে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা প্রয়োজন। এতে কৃষি উৎপাদনে উৎসাহিত হবে কৃষকেরা।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ বলেন, চরের ১২ হাজার ৪০২ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হচ্ছে। নদীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোকে কেন্দ্র করে কৃষি বিভাগ কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। এখানে জোয়ার-ভাটার একটা প্রভাব রয়েছে। তাই 'ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার' প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেখানে আমাদের কিছু প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে। কৃষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। মাঠ দিবসও করা হয়। চরের মাটি অত্যন্ত উর্বর। সেখানে সরিষা, ভুট্টা, বাদাম, তিল সম্ভাবনাময় ফসল। আমরা ব্যাপকভাবে এগুলো চাষাবাদের উদ্যোগ নিয়েছি।
আপনার মতামত লিখুন :