কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি: ৫ আগস্টের পর কিশোরগঞ্জ জেলায় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৪২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় সাংবাদিকসহ বহু নিরপরাধ ব্যক্তিকে এমনকি বিএনপির লোকজনকেও আসামি করা করেছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় গত ২৯ নভেম্বর হওয়া একটি মামলা নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে।
ওই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ১৮ জুলাই দুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারী ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে আক্রমণ করে। এ সময় তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে দুলাল রবিদাস নামে এক মুচির বুকে গুলি লাগে। এরপর ২২-২৩ জন আসামি রড দিয়ে পিটিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে কিশোরগঞ্জের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুলাল গৌরাঙ্গবাজার মোড়ে মুচির কাজ করতেন। তবে তিনি ১৮ জুলাই বাজারে যাননি।
তার ছোট ভাই কাঞ্চন রবিদাস জানান, তার বড় ভাই গুলিতে মারা যাননি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টের রোগী ছিলেন। ১৯ জুলাই শ্বাসকষ্টে বাড়িতে মারা গেছেন।
তিনি বলেন, আমরা শুনেছি, আমার ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে মামলা হয়েছে। মামলার পর আসামিসহ অনেকে আমাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু আমরা মামলার বিষয়ে কিছুই জানি না।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, জেলা শহরের মনিপুরঘাট এলাকার জসিম উদ্দিনের ছেলে রাফিউল আলম (২৫) মামলাটির বাদী। মামলায় ১৬৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মামলার বাদী সাংবাদিকদের জানান, কয়েকজনের পরামর্শ নিয়ে মামলাটি করেছেন। সেখানে ১৩০ জনের নাম তিনি দিয়েছিলেন। বাকি ৩৮ জনের নাম তিনি দেননি। এখানে ১৯ জন নিরীহ ব্যক্তি রয়েছেন। তিনি দাবি করেন, মামলার পর কেউ কেউ নাকি আসামিদের কাছ থেকে টাকা-পয়সাও নিচ্ছেন। অথচ তিনি কিছুই জানেন না। প্রকৃতপক্ষে তিনি এখন মামলা করে বেকায়দায় পড়েছেন।
তবে কিশোরগঞ্জ মডেল সদর মডেল থানার ওসি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, বাদীর দেওয়া এজাহার মতেই মামলার এফআইআর (প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন) হয়েছে। পুলিশ বা অন্য কারও নাম দেওয়ার সুযোগ নেই।
এ মামলা ছাড়াও আরেকটি মামলায় রুহুল আমিন নামে যুবদলের এক কর্মীকে আসামি করা হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলাটি করা হয়।
সেই মামলার বাদী কিশোরগঞ্জ আদালতের শিক্ষানবিশ আইনজীবী সুজন মিয়া। তিনি বলেন, তিনি রুহুলকে চেনেন না। কীভাবে মামলায় রুহুলের নাম ঢুকেছে, সেটাও জানেন না। শুধু রুহুল নন, এ মামলায় যে ৯০ জনকে আসামি করা হয়েছে, এর মধ্যে বেশির ভাগ আসামিকেই তিনি চেনেন না। এমনকি মামলায় তার নিজের আত্মীয়-স্বজনের নামও আসামির তালিকায় এসেছে। কীভাবে এসব নাম ঢুকলো তিনি জানেন না।
জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলায় ৪২টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় তিন হাজার ৫৫৯ জনের নাম উল্লেখ ও ১০ হাজারের বেশি লোককে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ২৭০ জনকে। আসামিরা মূলত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। এ ছাড়া আসামির তালিকায় জেলার ৭/৮ জন সাংবাদিকও আছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কিশোরগঞ্জে হওয়া অনেকগুলো মামলা নিয়েই সমালোচনা চলছে। এসব মামলার ক্ষেত্রে নিয়মনীতি ঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ আছে। মামলায় আসামির তালিকায় নাম দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগও আছে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম জানান, নিরপরাধ কাউকে যেন মামলায় জড়ানো না হয়, সে বিষয়ে নেতাদের নির্দেশ দেওয়া আছে। তবু অনেকে তাদের জিজ্ঞেস না করে মামলা করে দিচ্ছেন। কিছু মামলায় ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে কাউকে কাউকে আসামি করা হচ্ছে। বিষয়গুলো জানার পর আর যেন মামলা না নেওয়া হয়, সে জন্য বিভিন্ন থানার ওসিদেরও বলা হয়েছে। এরপরও অনেকে গিয়ে নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য থানাসহ আদালতে মামলা করে দিচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে এখন তারা উদ্বিগ্ন।
পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী জানান, ৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত কিশোরগঞ্জে ৪২টি মামলা করা হয়েছে। এতে সাড়ে তিন হাজারের মতো এজাহারভুক্ত আসামিসহ অজ্ঞাত কয়েক হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় ২৭০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রতিটি মামলার বিষয়ে সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
আপনার মতামত লিখুন :