অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় বিয়ের জন্য চাপ দিলে প্রেমিকা শাহিদা ইসলামকে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করে কথিত প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়। হত্যার কাজে ব্যবহৃত পিস্তলটি তৌহিদ গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর ওয়ারি থানা থেকে লুট করেন। পরে ইউটিউবে ভিডিও দেখে তিনি পিস্তল চালানো শিখেন।
মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেল ৩টার দিকে মুন্সীগঞ্জ আদালতে হাজির করলেন আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জুলফিকার হোসাইন রনির কাছে আসামি তৌহিদ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
তৌহিদের বরাদ দিয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক মো. ইয়াসিন।
ডিবির তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. ইয়াসিন বলেন, তন্ময়ের বিরুদ্ধে মোট তিনটি মামলা হয়েছে। হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি কেরানীগঞ্জ ডোবা থেকে উদ্ধারের ঘটনায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ওয়ারি থানা থেকে অস্ত্র লুটের ঘটনায় ওই থানায় দায়েরকৃত মামলায় তাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জে গুলি করে শাহিদাকে হত্যা করার ঘটনায় অপর একটি মামলাসহ সব মিলিয়ে তিনটি মামলার আসামি তিনি। হত্যায় ব্যবহৃত পিস্তলটি তৌহিদ গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর ওয়ারি থানা থেকে লুট করেন। এরপর তিনি ইউটিউবে ভিডিও দেখে পিস্তল চালানো শিখেছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ৪ বছর প্রেম করলেও প্রেমিক তৌহিদ শাহিদাকে বিয়ে করতে চায়নি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। একটি দুটি নয়, প্রকাশ্যে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের ওপর ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়ে আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা প্রেমিকাকে হত্যার পর ভোলার মনপুরা দ্বীপে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে আলোচিত শাহিদা হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি তৌহিদ। পরে তার দেয়া তথ্যে ঢাকার কেরানীগঞ্জের বটতলী বেইলি ব্রিজের নিচে পানি থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত সরকারি সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে এসব তথ্য জানান মুন্সীগঞ্জ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার।
পুলিশ জানায়, নিহত শাহিদার সঙ্গে তৌহিদের দ্বন্দ্ব ছিল। ঘটনার আগের দিন রাতে (২৯ নভেম্বর) শাহিদাকে ফোন করে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হতে বলেন তৌহিদ। পরে লোকাল বাসে করে দুজনেই চলে আসেন মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটে। রাতভর সেখানে ঘোরাঘুরির পর গত শনিবার ভোরে খানবাড়ি সিএনজি স্ট্যান্ড এলাকায় আসেন তারা। সেখানে প্রেমিকা শাহিদা প্রেমিক তৌহিদকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়।
আশপাশের লোকজন তাদের চিৎকার শুনে এগিয়ে আসতে থাকলে তৌহিদ ওই নারীকে নিয়ে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের সার্ভিস লেন ধরে পদ্মা সেতু উত্তর টোল প্লাজা থেকে ২০০ মিটার অদূরে দোগাছি ফুটওভার ব্রিজ পার করে। পথে কয়েক দফায় শাহিদাকে চড়থাপ্পড় মারে তৌহিদ। একপর্যায়ে আর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সঙ্গে থাকা থানা থেকে লুটকৃত পিস্তল দিয়ে প্রথমে এক রাউন্ড গুলি ছুড়লে সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পরপরই আরও ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়লে সেগুলো শাহিদার শরীরের বিভিন্ন অংশে বিদ্ধ হয়। মুহূর্তেই সড়কে উপুড় হয়ে পড়ে মৃত্যু হয় শাহিদার। রক্তাক্ত প্রেমিকার লাশ ফেলে পেছন দিকে দৌড়ে পালায় তৌহিদ। এরপর খানবাড়ি এলাকায় গিয়ে লোকাল বাসে চড়ে রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশ্য।
মাঝপথে পিস্তলটি ফেলে দেয় কেরানীগঞ্জ বেইলি ব্রিজের নিচে। এরপর ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে যাওয়ার চেষ্টা করে তৌহিদ। একপর্যায়ে আঁটিবাজার এলাকায় নিজের বোনের বাড়িতে গিয়ে ওঠে সে। ওই বাড়িতে বোন জামাই, বোন ও তৌহিদের মা লঞ্চে করে মনপুরা দ্বীপে আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয় তৌহিদকে। পরদিন রোববার সন্ধ্যায় ওই তিনজন সদরঘাট গিয়ে পৌঁছে দেয় তাকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা-ভোলা-মনপুরা রুটের লঞ্চে উঠে পড়ে তৌহিদ।
তৌহিদকে প্রধান সন্দেহভাজন চিহ্নিত করে তার মোবাইল নম্বরের সবশেষ লোকেশন নিশ্চিত হয় তারা। তখন দেখা যায়, তৌহিদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি শুক্রবার রাতে সবশেষ ঢাকার ওয়ারী এলাকায় চালু ছিল। এরপর থেকে সেটি বন্ধ আছে। এরইমাঝে আরেকটি সূত্র খুঁজে পায় ডিবি। তৌহিদের মোবাইল কলের সূত্র ধরে উদঘাটন হয় পরিবারের সকল সদস্যের নম্বর।
রোববার ডিবির দলটি যখন ঢাকার আঁটিবাজারে তৌহিদের বোনের বাড়িতে অভিযানে যায় তখন তারা একসঙ্গে তৌহিদের মা, বোন ও বোন জামাইয়ের মোবাইলের লোকেশন সদরঘাটে দেখতে পায়। এরপরে অভিযান কার্যক্রম আরও জোরদার করে ডিবি। গোয়েন্দা সংস্থার টিমটি ছুটে যায় সদরঘাটে। সিসিটিভি ক্যামেরায় তৌহিদের লঞ্চে উঠার দৃশ্য শনাক্ত করে তারা।
গ্রেপ্তারের পর ডিবির কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তন্ময় জানায়, গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশলের অংশ হিসাবে মাওয়া আসার আগে ঢাকার ওয়ারীতে থাকতেই মোবাইলটি বন্ধ করে দেয় সে। যাতে হত্যার পর লুকালেও পুলিশ কোনো ক্লু বের করতে না পারে।
এদিকে, সোমবার ভোরে মুন্সীগঞ্জ ডিবি পুলিশের ৫ সদস্যের ওই টিমটি অবস্থান নেয় ভোলার ইলিশা লঞ্চঘাটে। টার্গেট করা লঞ্চে অনুসন্ধানে ডিবির হাতে ধরা পড়ে তৌহিদ।
এর আগে গত রোববার সকালে নিহত শাহিদার মা জরিনা খাতুন শ্রীনগর থানায় প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়কে প্রধান অভিযুক্ত করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওইদিন দুপুরে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর রাতে ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানার বেগুনবাড়ির বরিবয়ান এলাকায় এলাকায় জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয় শাহিদার। উৎস: আরটিভি অনলািইন।
আপনার মতামত লিখুন :