এম আর আমিন, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম ওয়াসার ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার প্রকল্প কাজ শেষ উদ্বোধনের অপেক্ষায়। পটিয়া বোয়ালখালী কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলার শিল্প কারখানাসহ শিগগিরই গ্রাহক পর্যায়ে পানি সরবরাহের প্রত্যাশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।নতুনভাবে একই প্রকল্পের সাথে তিন উপজেলাসহ নগরীর বিরাট একটি অংশ সুপেয় পানির আওতায় আসছে।
কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালী উপজেলার মধ্যবর্তী জ্যৈষ্ঠপুরার ভান্ডালজুড়ি পাহাড়ি এলাকায় কর্ণফুলী নদীর তীরে ও দুই পাহাড়ের পাদদেশে ৪১.২৬ একর জায়গায় গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম ওয়াসার দৃষ্টিনন্দন ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার স্থাপন প্রকল্প।
চট্টগ্রাম নগরীর, পশ্চিম পটিয়া আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় অবস্থিত শিল্পাঞ্চলে পানি সঙ্কট দূরীকরণ এবং নগরির পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আধুনিকায়নে গৃহীত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ওয়াসার অন্যতম প্রকল্প ছিল বোয়ালখালী ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার ও সরবরাহ প্রকল্প।এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলসহ ১০ লাখ মানুষ সুপেয় পানির আওতায় আসবে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ‘ভান্ডালজুড়ি পানি শোধনাগার পরীক্ষামূলক উৎপাদন ও প্রকল্পে কমিশনিংয়ের (ট্রায়াল রান) কাজ চলছে। অফিসিয়াল সিডিউল পেলে যেকোন সময় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার প্রস্তুতি আছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। ফলে খুব শীঘ্রই ওয়াসার সেবার সাথে সংযুক্ত হবে দৈনিক ৬ কোটি লিটার শোধন ক্ষমতা সম্পন্ন এই প্রকল্পটি।
প্রকল্পের ব্যয় ১৯৯৫ কোটি টাকা ধরা হলেও খরচ হয়েছে প্রায় ১৭শ কোটি টাকা। নির্ধারিত ব্যয়ের প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খরচ কমেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের লাইফটাইম ধরা হয়েছে ৫০ বছর। কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তায়ং ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কন্সট্রাকশন কোম্পানী লিমিটেড এটির নির্মাণ কাজ করেছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ভান্ডালজুড়ি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম জানান, এই প্রকল্পের অধীনে পানি সরবরাহের জন্য ১৩০ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন লাইন রয়েছে। পরীক্ষামূলক উৎপাদন চালিয়ে পাইপগুলো পরিষ্কার ও জীবানুমুক্ত করা হয়েছে। কোথাও কোন ত্রুটি পাওয়া যায়নি। আমরা অফিসিয়াল সিডিউলের অপেক্ষায় আছি। সিডিউল পেলে যেকোন সময় আনুষ্ঠানিকভাবে সেবা দেয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। এ প্রকল্প চালু হলে দৈনিক ৬ কোটি লিটার পানি পাওয়া যাবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী উপজেলার ১০ হাজার আবাসিক গ্রাহকের মাঝে পানির সংযোগ দেওয়া হবে। এ প্রকল্প থেকে শিল্পাঞ্চলে ৮০ ভাগ এবং আবাসিকের গ্রাহকদের জন্য ২০ ভাগ পানি সরবরাহ করা হবে।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ভান্ডালজুড়ি প্রকল্পের মাধ্যমে ছোট-বড় ১৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে বাণিজ্যিক সংযোগ দেওয়া হবে, এসব প্রতিষ্ঠানে দৈনিক ৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহের টার্গেট আছে। এ ছাড়া আবাসিক গ্রাহকদের মাঝে দেওয়া হবে ২ কোটি লিটার। এ প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সরবরাহের জন্য পটিয়া বাইপাস এলাকায় ৫ একর জায়গায় এবং আনোয়ারার দৌলতপুর মৌজায় ২ দশমিক ৯৪ একর জায়গায় দুটি জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে বসানো হয়েছে ১১৩ কিলোমিটার পাইপ লাইন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘ভান্ডালজুড়ি প্রকল্পে দৈনিক ৬ কোটি লিটার পানি শোধন করার ক্ষমতা আছে, ১০ হাজার গ্রাহককে সেবা দেয়ার পরিকল্পনা আছে। প্রকল্পের অধীনে পানি সরবরাহের জন্য কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইকোনমিক জোন, সিইউএফএল, কাফকোসহ অন্যান্য শিল্পাঞ্চল ও দুই হাজারের মতো গ্রাহক আবাসিক সংযোগের জন্য আবেদন করেছে। ইতোমধ্যে ৭০০ গ্রাহককে সংযোগ পৌঁছে দিয়েছি। বাকি গ্রাহকের সংযোগ দেওয়ার কাজ চলমান আছে। আমরা চেষ্টা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে পানি সরবরাহ শুরু করতে।
চট্টগ্রাম ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় দাতা সংস্থা কোরিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (কোইকা) চট্টগ্রামের পানি সরবরাহ বৃদ্ধি ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য একটি মাস্টারপ্লান প্রণয়ন করেছিলেন। ওই মাস্টারপ্ল্যান মোতাবেক চট্টগ্রাম ওয়াসা বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয় তার মধ্যে বোয়ালখালী ভান্ডালজুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্পটি ছিল অন্যতম।
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম ওয়াসা দৈনিক ৬ কোটি লিটার পানি সরবরাহের জন্য ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ প্রকল্পের জন্য কর্ণফুলী নদী থেকে পানি এনে প্রকল্পে শোধন করে ওই পানি তিন উপজেলা আনোয়ারা বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী উপজেলার শিল্পাঞ্চলে ৮০ ভাগ আবাসিকের জন্য ২০ ভাগ পানি সরবরাহ করা হবে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার সেবার পরিধি বৃদ্ধি ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে আবাসিক ও শিল্প কারখানায় পানি সরবরাহ করতে ২০১৬ সালে ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকায় চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালী উপজেলার মধ্যবর্তী জ্যৈষ্ঠপুরার ভান্ডালজুড়ি পাহাড়ি এলাকায় ৪১ দশমিক ২৬ একর জায়গায় জুড়ে গড়ে ওঠে এই প্রকল্প। ২০২০ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ভূমি জটিলতায় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয় নির্মাণকাজ। ফলে ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রথম সংশোধিত আকারে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৯৯৫ কোটি ১৫ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। প্রকল্পের ৮২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা অর্থায়ন করছে কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে ১ হাজার ১৫০ কোটি ৬৫ লাখ এবং চট্টগ্রাম ওয়াসা নিজস্ব তহবিল থেকে দিয়েছে ২০ কোটি টাকা। এরমধ্যে কোরিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ফি বাবদ দেয়া হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছে নির্মাণকারী কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান ’তায়ং ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কন্সট্রাকশন কোম্পানী লিমিটেড’।
আপনার মতামত লিখুন :