গৃহশিক্ষিকা থেকে বাদ দেওয়ায় প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে কানাইঘাটে ৫ বছর বয়সী শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনকে অপহরণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে মর্মে ধারণা করছেন পুলিশ ও নিহতের পরিবার।
সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস্) মো রফিকুল ইসলাম জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ হত্যাকাণ্ডে তারা গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগম মার্জিয়ার (২৫) সম্পৃক্ততা পেয়েছেন। গৃহশিক্ষিকা বাদ দেওয়াই ক্ষুব্ধ হয়ে মর্জিনা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন। তবে এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে কি না পুলিশ তাও খতিয়ে দেখছে।
তিনি জানান, আড়াইশ টাকা বেতনে মুনতাহাকে পড়াতো মার্জিয়া। দুই থেকে আড়াই মাস আগে তাকে এ থেকে বাদ দেওয়া হয় বলে জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশ এ ঘটনায় ৩ নারীসহ ৪ জনকে আটক করেছেন।
গত ৩ নভেম্বর দুপুরে নিখোঁজ হয় কানাইঘাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরদলের ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের শিশু কন্যা মুনতাহা। দিনভর অনেক খোঁজাখুজির পর মুনতাহা ফিরে না আসায় থানায় জিডি করে পরিবার। নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর, ভোররাতে প্রতিবেশী আলিফজান বিবিকে লাশ ডোবা থেকে পুকুরে ফেলার সময় হাতেনাতে আটক করা হয় তাকে। এ ঘটনার পর ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী মার্জিয়ার বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। মুনতাহা ছিল শামীম আহমদের ৫ মেয়ে ও ২ ছেলের মধ্যে সবার ছোট। সে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়তো।
মুনতাহার পিতা শামীম আহমদ বলেন, “মুনতাহার এক সময়ের গৃহশিক্ষিকা ছিল মার্জিয়া। কিন্তু খারাপ আচরণের কারণে তাকে গৃহশিক্ষিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। এতে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠেন মার্জিয়া। এর অংশ হিসেবে তার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, ‘‘এই কষ্টটা আমার সহ্য হবে না। প্রত্যেকের মা-বোন আছে, বাচ্চা-কাচ্ছা আছে। আমার মেয়েকে ওরা কষ্ট দিয়ে মেরেছে।”
যেভাবে খুন করা হয় মুনতাহাকে: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পুলিশ ধারণা করছে, গত ৩ নভেম্বর নিখোঁজের দিন মুনতাহাকে কৌশলে মার্জিয়া এবং তার মা আলিফজান বিবি (৫৪) তাদের বসত ঘরে নিয়ে যায়। মুনতাহার মুখের মধ্যে ওড়না ঢুকিয়ে এবং গলায় রশি দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তারা। এরপর মরদেহ বস্তাবন্দী করে ঘরের মধ্যে রেখে দেয় হত্যাকারীরা। এরপর গভীর রাতে মরদেহ পলিথিনে মুড়িয়ে বসত ঘরের পাশে খালের নর্দমায় পুঁতে রাখে। মুনতাহার পরিবারের লোকজন মার্জিয়া সহ তার পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে থাকে। মার্জিয়ার পরিবারের লোকজনের চলাফেরা ও কথাবার্তায় সন্দেহ হয় মুনতাহার পরিবারের।
গত শনিবার রাতে থানা পুলিশ মার্জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। এতে ইতস্তত হয়ে পড়েন হত্যাকারীরা। পুলিশ মুনতাহার পরিবারকে মার্জিয়ার পরিবারের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলে। শনিবার রাতে মার্জিয়ার মা আলিফজান বিবি মুনতাহার পুঁতে রাখা লাশ তুলে নিয়ে পার্শ্ববর্তী বাড়ির পুকুরে ফেলার চেষ্টা চালায়। এ সময় তাকে (আলিফজান) হাতেনাতে ধরে ফেলেন স্থানীয়রা। তাৎক্ষণিক থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আলিফজান বিবি এবং তার মা কুতুবজান বিবিকে (৭০) আটক করে থানায় নিয়ে আসে। আটক আলিফজান বিবি ও তার মেয়ে শামিমা বেগম মার্জিয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে স্থানীয় বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামেরমৃত ছইদুর রহমানের ছেলে ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও মামুন রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগম (৩০) কে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত ৪ জনকে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
মুনতাহাদের মালিকানাধীন খাস জমিতে থাকতো মার্জিয়ার পরিবার
স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, মার্জিয়ার মা আলিফজান ছিলেন পেশায় ভিক্ষুক। যে কারণে পরিবারটির প্রতি সহানুভুতিশীল হয়ে তার বাড়ির পাশে আলিফজান ও মেয়ে মার্জিয়াকে এক খন্ড খাসজমি প্রদান করেন। ওই জমিতে একটি ঘর বানিয়ে বসবাস করতো ওই পরিবার। এই সুবাদে মুনতাহার পরিবারের সঙ্গে তাদের সখ্যতা। এক পর্যায়ে মুনতাহাকে পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় মার্জিয়াকে। স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ছাত্রী মার্জিয়াকে কিছুদিন পড়ানোর পর খারাপ আচরণের কারণে প্রায় দুই থেকে আড়াই মাস আগে তাকে গৃহশিক্ষিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এ কারণে পরিবারটি প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল মার্জিয়া।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে পুলিশ সুপার : রবিবার বিকেল ২টার দিকে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি মুনতাহার শোকাহত পরিবারবর্গকে সান্ত্বনা দেন এবং হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের আশ্বাস দেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পুলিশ সুপার বলেন, “শিশু মুনতাহাকে উদ্ধার করে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কারা সম্পৃক্ত পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্তার অভিযোগে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদেরও দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।”
ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে পুলিশ সুপারের সঙ্গে ছিলেন- সিলেট জেলার এডিশনাল পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম, কানাইঘাট সার্কেলের এএসপি অলক কান্তি শর্মা, থানার ওসি আব্দুল আউয়াল।
যেভাবে নিখোঁজ হয় মুনতাহা : পারিবারিক সূত্র জানায়, গত ৩ নভেম্বর দুপুর বেলা শিশু মুনতাহা জেরিন তার বাড়ি থেকে পার্শ্ববর্তী আব্দুল ওয়াহিদের বাড়ির শিশুদের সঙ্গে খেলতে যায়। ঐদিন বিকেল পর্যন্ত শিশু মুনতাহা বাড়িতে ফিরে না আসায় পরিবার তাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। এক পর্যায়ে মেয়েকে না পেয়ে পিতা শামীম আহমদ কানাইঘাট থানায় একটি জিডি করেন। দুদিন পর থানায় একটি এজাহার দাখিল হয়। ফুটফুটে মুনতাহা নিখোঁজের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গণমাধ্যমে বিষয়টি শিরোনাম হয়। এরপর শনিবার দিবাগত রাতে উদ্ধার হয় তার অর্ধগলিত মরদেহ।
থানায় হত্যা মামলা : শিশু মুনতাহাকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যাকান্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত আলিফজান, মার্জিয়া, ইসলাম উদ্দিন ও নাজমা বেগমের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আউয়াল জানিয়েছেন। তবে আলিফজান বিবিকে মামলায় আসামী দেখানো হয়নি।
জানাজা শেষে লাশ দাফন : সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্তশেষে রবিবার বিকেলে মুনতাহার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এ সময় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। আত্মীয়-স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। উপস্থিত এলাকার বিপুল সংখ্যক লোক মুনতাহা হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবী জানান। বাদ আছর বীরদল পুরানফৌদ জামে মসজিদে জানাজা শেষে গ্রামের পঞ্চায়েতি কবরস্থানে তাকে চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়।
মুনতাহার চাচা কয়সর আহমেদ বলেন, “মুনতাহার সাবেক গৃহশিক্ষিকা মার্জিয়া পূর্ব শত্রুতার জেরে অপহরণ করে হত্যা করে। পরে বাড়ির পাশে ডোবায় কাঁদার নিচে পুঁতে রাখে। গতরাত আনুমানিক ৩ টার দিকে মার্জিয়ার মা আলিফজান বিবি সেই লাশ সরিয়ে নিতে গেলে জনতার হাতে আটক হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।” উৎস: ঢাকা ট্রিবিউন।
আপনার মতামত লিখুন :