ফেনী প্রতিনিধি: ফেনীর জনপদে পরপর তিনদফা বন্যায় কৃষিখাতে হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। আগামীর খাদ্য নিরাপত্তায় শঙ্কার মাঝে কৃষকের কাছে নতুন ভীতি ফসল বিনাশী পোকার মারাত্মক আক্রমণ।
কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, কালো বর্ণের এই ভয়ঙ্কর পোকার নাম ফল আর্মিওয়ার্ম। সোনাগাজী এবং ফুলগাজী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ফসলি জমি ও জনপদে এ পোকার অস্বাভাবিক উপদ্রব দেখা দিয়েছে। পোকার এ উপদ্রবকে মহামারী হিসেবে দেখছেন স্থানীয় কৃষকরা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সপ্তাহখানেক আগ থেকে সোনাগাজীর আমিরাবাদ ও ফুলগাজীর বিভিন্ন ইউনিয়নে ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থানে কাটুই পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। সোনাগাজীতে বন্যার পানিতে এ পোকা ভেসে এসেছে বলে ধারণা করছেন স্থানীয় কৃষকরা।
কৃষি বিভাগ বলছে, ফসলের জন্য ক্ষতিকর এ পোকা দমনে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করছেন তারা। অন্যদিকে কৃষকরা বলছেন, জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করেও পোকা দমন করা যাচ্ছে না।
সোনাগাজীর উপজেলার আমিরাবাদে গিয়ে দেখা যায়, কালো বর্ণের অসংখ্য পোকা ফসলের মাঠে, রাস্তায়, বাড়িঘর এবং আশপাশের বন-জঙ্গলে বিচরণ করছে। কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, এই পোকা পানিতে থাকতে পারে না। তবে সরেজমিন দেখা মিলেছে বিপরীত চিত্রের। দেখা গেছে, পুকুর, ডোবা-নালাসহ আমন ধানের মাঠে পানি থাকলেও পোকাগুলো পানি ওপর দিয়েই হেঁটে বেড়াচ্ছে এবং একস্থান হতে অন্যস্থানে যাচ্ছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, বন্যার পর জমিতে আমন ধান লাগিয়েছেন তারা। এছাড়া বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম শীতকালীন ফসল লাউ, কুমড়া, করলা, জিঙ্গা, পাট শাক, চিচিঙ্গা আবাদ করেছেন, সাপ্তাহখানেক পর সেগুলো বিক্রির উপযোগী হতো। এরই মধ্যেই শুরু হয়েছে এই পোকার ব্যাপক আক্রমণ। পোকার আক্রমণ কমাতে জমিতে কীটনাশক ছিটিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। পোকার আক্রমণে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয়ের শঙ্কা করছেন কৃষকরা। একই কথা বলছেন ফুলগাজী উপজেলার কৃষকরাও। সেখানেও ফসলের মাঠে এ পোকার আক্রমণ প্রকট আকার ধারণ করেছে।
সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের আহম্মদপুর, চর কৃষ্ণজয় এলাকায় এবং লেমুয়া ইউনিয়নের কসবা, ধর্মপুর, নিরগঞ্জ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকের চাষ করা পাট শাক, কলমির শাক, শিম, কুমড়ো, লাউ, ঝিঙ্গে, বেগুন গাছের পাতা এবং কান্ডে কালোবর্ণের এই পোকার উপস্থিতিতে গাছের সবুজ রং কালো দেখাচ্ছে। রাস্তাঘাট, পুকুর, ডেবা-নালা, ফসল বিহীন জমির ঘাসসহ সর্বত্র এ পোকার উপদ্রব দেখা গেছে। এ পোকার আক্রমণে ধানসহ অন্যান্য উদ্ভিদের পাতা শুকিয়ে বাদামী হয়ে পড়ছে।
আমিরাবাদের আহম্মদপুরের কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ১২ শতক জমিতে লাউ গাছের লাগিয়েছিলাম। হঠাৎ এই পোকা এসে সবগুলো গাছের গোড়া কেটে দিয়েছে। এতে লাউ গাছগুলো শুকিয়ে মারা গেছে। বাগান থেকে ১০ হাজার টাকার লাউ পাবো বলে আশা করেছিলাম। এখন সব শেষ হয়ে গেলো। কৃষি অফিসের পরামর্শে কীটনাশক প্রয়োগ করেও লাভ হয়নি। পোকাগুলোকে কীটনাশকের পানিতে রাখলেও সেগুলো মরে না।
আহম্মদপুর এলাকার কৃষক সিরাজুল হক বলেন, প্রতি বছর শাকসবজির আবাদ করে থাকি। এই ধরনের পোকার উপদ্রব আগে কখনো দেখিনি। কীটনাশক ছিটিয়েও কোন লাভ হচ্ছে না। আমরা নিরুপায় হয়ে পড়েছি। আমার ৬ শতক জমিতে লাগানো পাট শাক খেয়ে ফেলেছে পোকা।
আমিরাবাদের চর কৃষ্ণজয় গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, এত পোকা আমার ৫৫ বছরের জীবনে কখনো দেখিনি। দেখতেও ভয় লাগে, কাছে গেলে গায়ে উঠে যায়। আমাদের বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে সেগুলো। বাড়ির পাশে ৮০ শতক জমিতে ধান লাগিয়ে এখন পোকার আক্রমণে ভয়ে আছি।
একই চিত্র দেখা গেছে ইউনিয়নের কাতু সওদাগর বাড়িতেও। এই বাড়ির কৃষক মোস্তফা বলেন, বন্যার ক্ষতি কাটাতে ৬০ শতক জমিতে আগাম শাক সবজি লাগিয়েছি। এখন সেগুলোও পোকায় খেয়ে ফেলছে। চেষ্টা করেও ফসল বাঁচাতে পারছি না।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, আর্মিওয়ার্ম পৃথিবীব্যাপী একটি ক্ষতিকারক হিসেবে পোকা হিসেবে পরিচিত। এটি প্রায় ৮০ প্রকার ফসলে আক্রমণ করে থাকে।
সোনাগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাঈন উদ্দিন আহমেদ সোহাগ বলেন, এ পোকার আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষায় কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া পোকা দমনে ইউনিয়ন পর্যায়ে আমাদের টিম কাজ করছে। এটি দমনে কৃষকদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে কৃষি বিভাগ।
ফুলগাজী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম জানান, ফুলগাজীতে এ পোকার উপদ্রব ঠেকাতে তিন ধরনের ঔষধ ছিঁটানো হয়েছে। নাইট্রো, কোরাজেন মিশ্রিত করে স্প্রে করায় পোকা দমন হয়েছে। পোকা দমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৬ লিটার কন্টেইনারে ৩০ মি.লি মেট্রো ও ১৫ মি.লি. কোরাজেনের মিশ্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, বন্যার সময় কিছু কীটের লার্ভা ফসলের মাঠে আগাছায় থাকার ফলে এ পোকা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফুলগাজীর আমজাদহাট ইউনিয়নের মলিপুরেও এমন পোকা দেখা মিলেছে। তবে মুন্সীরহাটের দক্ষিণ শ্রীপুরে এর প্রাদুর্ভাব বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
কেবল ফসলের মাঠ নয়, ঘরে বাড়িতেও এ ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার উপদ্রব বেড়েছে। সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের চর কৃষ্ণজয় গ্রামের কৃষক ছুট্টো মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাড়ির রাস্তায়, বসত ঘর, টিউবওয়েল, শৌচাগার, বাড়ির উঠানসহ আঙ্গিনায় হাজার হাজার পোকা কিলবিল করছে।
ছুট্টো মিয়া বলেন, এ ভয়ঙ্কর পোকা এর আগে আমি কখনো দেখিনি। আমার বাড়িতে এতো পোকা ঢুকেছে যে আমরা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেও পারছি না। রাতে ঘুমালে গায়ে উঠে যায় পোকা। সে কারণে রাতে ঘুমাতে পারি না। গায়ে লাগলে চুলকায়। বাড়ির চারদিকে কীটনাশক ছিটিয়েও কাজ হচ্ছে না, দিন দিন পোকার আরো বাড়ছে। একমাত্র ঝাড়ু দিয়ে বারবার পরিষ্কার করে আগুন লাগিয়ে দিলে মারা যায়। এতে তীব্র গন্ধে বাড়িতে দম আটকে আসে। সেজন্য আগুন লাগানোও বন্ধ করেছি।
তিনি আরো বলেন, শুধু তাই নয় এই পোকা শৌচাগার এবং টিউবওয়েলেও ঢুকে পড়েছে। আমরা খাবার পানিও খেতে পারছি না। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, বাড়ি ছেড়ে মেয়ের বাড়িতে চলে যাবো বলে ঠিক করেছি।
লেমুয়া ইউনিয়নের কসবা গ্রামের বাসিন্দা সিএনজি চালক বেলাল এবং আকবর হোসেন রূপক জানান, আমাদের বাড়ির আঙিনায় এতো বেশি পোকা এসেছে যে আমরা হাঁটা চলা করতে পারছি না। বিশেষ করে ছোট বাচ্চারা বেশি ভয়ে আছে। কালো ৩-৪ ইঞ্চির পোকা দেখতেও ভয়ঙ্কর লাগছে। আমার ফসলের ক্ষেত এরই মধ্যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয় এই পোকা খেয়ে আমাদের বাড়ির ৫টি মুরগি মারা গিয়েছে। পুকুরের পানিতে এত বেশি পোকা কিলবিল করছে যে জেলেরা মাছ না ধরে চলে গেছে।
ফসলবিনাশী ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার আক্রমণে জেলায় ফসল উৎপাদনে ফের বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে ফেনী সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোতাহার হোসাইনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বন্যা এ পোকার উপদ্রবের অন্যতম কারণ হতে পারে। পোকাটি সাধারণত মাঝারি ঠান্ডা ও গরমে বেশি বংশবিস্তার করে। বর্তমান সময়ের আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি অনুকূলে রয়েছে। যা আমাদের জন্য বাড়তি শঙ্কার বিষয়।
তিনি বলেন, গ্রীষ্মকালে পোকাটি ৩০-৩৫ দিনে ও শীতকালে ৭০-৮০ দিনের জীবনচক্র সম্পন্ন করে। স্ত্রী জাতের পোকা সাধারণত পাতার নিচের দিকে ১৫০০-২০০০টি ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়া বের হয়ে পাতা বা ফল খাওয়া শুরু করে। পূর্ণাঙ্গ কীড়া মাটির ৮-১২ সেন্টিমিটার নিচে পুত্তুলিতে পরিণত হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় পোকাটি ৪-৫টি জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। জীবনচক্রের বিভিন্ন ধাপে পূর্ণাঙ্গ পোকা অনেকদূর পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে। এমনকি ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে কয়েকশ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, পোকাটির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজারে রিপকর্ড নামে কার্যকরী একটি স্প্রেজাতীয় ওষুধ রয়েছে। কৃষকরা যদি যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেন, তাহলে ২০ শতাংশ ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতা নিয়ে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ আমেরিকার এ পোকা আনুমানিক পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশে প্রথম দেখা মেলে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে ফেনীর সোনাগাজী ও ফুলগাজী উপজেলার বেশ কয়েকটি স্থানে এ পোকার দেখা মিলছে। এতে জেলার আগামীর কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. একরাম উদ্দিন বলেন, গত বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) জেলায় প্রথমবারের মতো এ পোকার উপদ্রবের বিষয়ে অবগত হয়েছি। এখন পর্যন্ত সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ও আমিরাবাদ এবং ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর এলাকায় এ পোকার দেখা মিলেছে বলে জেনেছি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছেন। বিভিন্ন বালাইনাশক কোম্পানির প্রতিনিধিদেরও এতে যুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে জমিতে আলোর ফাঁদ ও পাখি বসার মতো কিছু বসাতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া বাজার থেকে বিভিন্ন বালাইনাশক প্রয়োগের বিষয়েও কৃষকদের বলা হচ্ছে। ফসল অনুযায়ী জমিতে সম্ভব হলে পানি রাখতেও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে শঙ্কা থাকলেও এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, বাকিটা আল্লাহর উপরই। মাঠ পর্যায়ে থেকে এ ব্যাপারে কৃষকদের সহায়তা করতে কৃষি বিভাগ সচেষ্ট রয়েছে বলে জানান এ কৃষিবিদ। সূত্র : ডেইলি বাংলাদেশ
আপনার মতামত লিখুন :