পঞ্চগড় প্রতিনিধি: দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন দিনমজুর আব্দুর রশিদ। অর্থের অভাবে থমকে যায় তার চিকিৎসা। স্বামীকে বাঁচাতে তিন দিনের কন্যাসন্তান বিক্রি করে দেন স্ত্রী রোকেয়া বেগম। সেই টাকা দিয়ে শুরু হয় চিকিৎসা। কিন্তু সেই টাকাও শেষ হয়ে যায়। একদিকে টাকার অভাব ও অন্যদিকে আব্দুর রশিদের কাছে ছিল না বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্মসনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র। এ কারণে তার ভাগে জোটেনি সরকারি বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা।
এদিকে গত ৯ সেপ্টেম্বর সন্তান বিক্রির প্রতিবেদন বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত ও প্রকাশিত হওয়ার পর পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি বিষয়টি জানতে পারেন। এরপর সেই শিশুকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন ইউএনও। এ ছাড়া গত সোমবার দিবাগত রাতে আহত আব্দুর রশিদকে ইউএনও নিজেই তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি করেন।
আব্দুর রশিদ তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের মালিগছ এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে। তিনি দিনাজপুর জেলা শহরের রাজবাড়ী এলাকায় ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকতেন। সেখানে তিনি ট্রাক্টর শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন।
তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেটের সামনে গুলিবিদ্ধ হন আব্দুর রশিদ। পরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন তাকে উদ্ধার করেন এবং তাদের আর্থিক সহযোগিতায় আব্দুর রশিদ চিকিৎসা করা হয়। কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে ফেরেন তিনি। স্ত্রীর প্রসবের সময় যখন ঘনিয়ে আসে, ঠিক তখনই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। এরপর গত ৮ আগস্ট আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। পরের দিন তার অপারেশন হয়। এরপর পর দিন দিনাজপুরে বাড়িতে তার স্ত্রী এক কন্যাসন্তান জন্ম দেন। এদিকে অর্থসংকট ও বাংলাদেশের নাগরিকত্বের কোনো কাগজপত্র না থাকায় এক পর্যায়ে আব্দুর রহিমের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়।
এ অবস্থায় স্বামীর জীবন বাঁচাতে গত ১২ আগস্ট রংপুরের এক দম্পতির কাছে মাত্র ২৫ হাজার টাকায় নিজের নবজাতকে বিক্রি করে দেন। এসব তথ্য জানার পর তৎপর হয়ে ওঠে তেঁতুলিয়ার ইউএনও। সেই শিশুকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন তিনি। এদিকে আব্দুর রশিদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ইউএনও ভজনপুর ইউনিয়ন পরিষদে যান। তিনি অপর একটি দলকে পাঠান মালিগছ এলাকার নজরুল ইসলামের বাড়িতে। খবর পাওয়ামাত্রই আব্দুর রহমানের বাবা নজরুল ইসলাম, কয়েকজন নিকটাত্মীয়সহ স্থানীয়রা উপস্থিত হন ইউনিয়ন পরিষদে।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আব্দুল রশিদের মা রশিদা বেগম ১০ বছর আগে মারা যান। পরে তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বিভিন্ন বিষয়ে বনিবনা না হওয়ায়, একসময় ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান আব্দুর রশিদ।
আব্দুর রশিদের বাবা বলেন, ‘আব্দুর রশিদ আমার ছেলে, বিষয়টি আমি উপজেলা প্রশাসনকে জানাই। পরে ইউএনও আমার ছেলেকে জন্মসনদ তৈরি করে দেন এবং তার চিকিৎসার দায়িত্ব দেন।’
আহত আব্দুর রশিদ বলেন, ‘পরিচয় না থাকায় সবাই আমার চিকিৎসা করতে ভয় পায়। বিষয়টি ফোনে ইউএনও স্যারকে জানালে তিনি বসে থেকে আমার জন্মসনদ তৈরি করে দেন। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। মধ্যরাত পর্যন্ত তিনি আমার পাশেই ছিলেন।
এদিকে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফজলে রাব্বি বলেন, ‘আব্দুর রশিদের স্ত্রীর সন্তান বিক্রির মর্মান্তিক ঘটনা জানার পর জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশে ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ স্থানীয়দের সহযোগিতায় কাজটি সম্ভব হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আব্দুর রশিদের শরীরে এখনো গুলি রয়েছে। এ ছাড়া পূর্বের অপারেশন থেকে তিনি এখনো আশঙ্কামুক্ত নন। শারীরিকভাবে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তিনি উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকবেন। যদি প্রয়োজন হয়, তবে আরও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।
এদিকে গত সোমবার সন্ধ্যায় তেঁতুলিয়ার উপজেলা পরিষদে হলরুমে আব্দুর রশিদকে চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা সহায়তা দেয় ‘লাভ শেয়ার বিডি ইউএস’ নামে একটি সামাজিক সংগঠন। এ উপলক্ষে জাগ্রত তেঁতুলিয়ার আয়োজনে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির সমন্বয়ক ফিরদৌস আলম লিটন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফজলে রাব্বি। আরও উপস্থিত ছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তেঁতুলিয়ার সমন্বয়ক হযরত আলী, ওবায়দুল হক, উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি খন্দকার আবু সালেহ ইব্রাহিম ইমরানসহ অন্যরা। সূত্র : খবরের কাগজ
আপনার মতামত লিখুন :