শিরোনাম
◈ ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইবে বাংলাদেশ: জানালেন আইন উপদেষ্টা ◈ জাহাঙ্গীরনগরে ‘গণপিটুনিতে’ সাবেক ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু ঘিরে রহস্য ◈ তমা মির্জার সঙ্গে সম্পর্ক ফাটলের গুঞ্জন, যা বললেন রাফি (ভিডিও) ◈ ‘মারছে, ভাত খাওয়াইছে, এরপর আবার মারছে, ভাত খাওয়াইছে : তোফাজ্জলের মামাতো বোন (ভিডিও) ◈ ঢাবিতে পিটিয়ে যুবক হত্যার ঘটনায় ৪ শিক্ষার্থী আটক ◈ শামীম ওসমানের পুরোনো ভিডিওটি ভাইরাল : ‘ফিরব কি না জানি না’ ◈ জাদেজা-অশ্বিনের জুটিতে টেস্টের নিয়ন্ত্রণ হারালো বাংলাদেশ ◈ দিল্লিতে মেয়ের সঙ্গে থাকছেন শেখ হাসিনা, ঘুরতে দেখা গেছে পার্কে : ফিনান্সিয়াল টাইমসের রিপোর্ট ◈ ফের নেতাকর্মীদের জন্য আওয়ামী লীগের জরুরি নির্দেশনা ◈ মণিপুরের সহিংসতায় মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতার বসাচ্ছে ভারত

প্রকাশিত : ২৫ জুলাই, ২০২২, ০৪:০৪ সকাল
আপডেট : ২৫ জুলাই, ২০২২, ০৪:০৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

তবুও অরক্ষিত ৬৭% রেলক্রসিং

ছবি: সংগৃহীত

যায়যায়দিন: সারা দেশে ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে বৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৪১২টি; এর মধ্যে ৯৪৬টিতে, অর্থাৎ ৬৭ শতাংশে গেট নেই। নেই যান নিয়ন্ত্রণের কোনো কর্মীও। নেই সংকেত বাতি। এ ছাড়া রেললাইনের উপর দিয়ে স্থানীয় লোকজন অবৈধ রাস্তা নির্মাণ করায় এ হিসাবের বাইরে আরও বিপুল সংখ্যক মরণ ফাঁদ তৈরি হয়েছে। রেলওয়ে সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

রোববার গাজীপুরের শ্রীপুরে এমনই একটা অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে যাত্রীবাহী বাসে ট্রেনের ধাক্কায় চার জন নিহত এবং কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। সকাল আনুমানিক সাড়ে ৭টায় উপজেলার মাইজপাড়া কমলাদিঘী এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। শ্রমিক বহনকারী একটি বাস মাইজপাড়া এলাকায় রেললাইন অতিক্রম করছিল। সে সময় বাসটিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা নেত্রকোনাগামী বলাকা কমিউটার এক্সপ্রেস ট্রেন ধাক্কা দেয়। দুর্ঘটনার সময় ওই রেলক্রসিংয়ে কোনো গেটকিপার ছিল না। জ্বলেনি ট্রেন আসার কোনো সিগন্যাল বাতিও।

এর আগে ৪ জুন নরসিংদীর রায়পুরার আমিরগঞ্জে রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় পিকআপ ভ্যানের তিন যাত্রী নিহত ও দুই জন আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হাসনাবাদ বাজার রোড থেকে আসা একটি পিকআপ ভ্যান অরক্ষিত হাসনাবাদ রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় ঢাকা থেকে সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ধাক্কা দেয়। এতে পিকআপ ভ্যানটি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে ভেতরে থাকা দুই যাত্রী ঘটনাস্থলেই মারা যান।

শুধু অরক্ষিত রেলক্রসিংয়েই নয়- সুরক্ষিত রেলক্রসিংয়েও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। তবে এ সংখ্যা কিছুটা কম। এ ছাড়া রেলওয়ের অনুমতি ছাড়াই যেসব রেললাইনের উপর দিয়ে অবৈধভাবে যানবাহন ও পথচারী চলাচল করছে, সেখানেও প্রায় প্রতিনিয়ত ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে।

রেলওয়ে এবং রেলওয়ে পুলিশের দুর্ঘটনাসংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অরক্ষিত ও সুরক্ষিত সব ধরনের রেলক্রসিংয়ে পথচারীরা সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির শিকার হচ্ছে। তবে রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের নিচে গাড়ি চাপা পড়া ও ধাক্কা খেয়ে ছিটকে প্রাণহানির ঘটনাও কম নয়। গত এক বছরে রেলক্রসিংয়ে ৩৩টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছে। অবশ্য এই হিসাবে, রেললাইনে কাটা পড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে অনুমোদনহীন রেলক্রসিংয়ের বেশির ভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সড়কে। আরও আছে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) সড়কে।

সংশ্লিষ্টরা জানান,

সরকারের কমবেশি পাঁচটি সংস্থা রেললাইনের উপর সড়ক নির্মাণ করার কারণে রেলক্রসিং সৃষ্টি হয়েছে। রেলের নিজেদেরও রেলক্রসিং আছে। রেলসহ এই সরকারি সংস্থাগুলো গত এক দশকে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। কিন্তু রেলক্রসিং সুরক্ষায় কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। দায় চাপাচ্ছে একে অপরের ঘাড়ে। রেলের আইনে রেলক্রসিংয়ে মৃতু্যর জন্য কোনো ক্ষতিপূরণেরও ব্যবস্থা নেই। অন্য সংস্থাগুলো প্রাণহানির বিষয়টি আমলেই নেয় না। ফলে একের পর এক রেলক্রসিংয়ে মানুষ মারা গেলেও কাউকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবারকে সমবেদনা জানানোরও কেউ নেই।

রেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, নতুন রেললাইন তৈরি করে প্রথম ট্রেন চালানোর ১০ বছরের মধ্যে এর উপর দিয়ে কোনো সড়ক গেলে তা সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রেলের। এরপর কোনো সড়ক নির্মাণ হলে তা আগে রেল কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। সড়কের কারণে তৈরি রেলক্রসিংয়ে পথরোধক ও পাহারাদার দিয়ে তা সুরক্ষণ করার দায়িত্ব সড়ক নির্মাণকারী সংস্থার। রেলের স্থায়ী ক্রসিংয়ের সবই পর্যায়ক্রমে সুরক্ষিত করা হলেও অন্যান্য সংস্থার কারণে সৃষ্ট ক্রসিংয়ে উড়ালসড়ক কিংবা পাহারাদার বসানোর অনুরোধ জানিয়ে বহুবার চিঠি দিয়েও আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। তাই বিপুল সংখ্যক রেলক্রসিং অরক্ষিতই রয়ে গেছে। এ সংখ্যা দিনে দিনে আরও বাড়ছে।

উলেস্নখ্য, রেলওয়ে আইন ১৮৯০-এর ১২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ট্রেনের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে বা বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তার সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদন্ড হবে। রেল কর্তৃপক্ষ রেললাইনের উপর দিয়ে রাস্তা নেওয়াকে সেই ধরনের অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে। এলজিইডিসহ বিভিন্ন সংস্থাকে অবৈধ ক্রসিংয়ের বিষয়ে চিঠি লেখার সময় আইনের এই ধারা তারা উলেস্নখ করে।

রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের হিসাবে, পূর্ব ও পশ্চিম রেলের দুই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি অবৈধ লেভেল ক্রসিং সৃষ্টি করেছে এলজিইডি। এলজিইডির কারণে সৃষ্ট অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা ৪৪২টি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্মাণ করেছে ৩৬৩টি, পৌরসভা ৭৯টি, সিটি করপোরেশন ৩৪টি, জেলা পরিষদ ১৩টি ও সওজ ১১টি। ৩৩টি লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করা হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে। এ ছাড়া রেললাইনে বাজারও বসছে।

জানা গেছে, ট্রেন চলাচলের সংখ্যা হিসাবে লেভেল ক্রসিংয়ে এক থেকে চারজন গেটকিপার থাকেন। আট ঘণ্টার শিফট হিসাবে ক্রসিংয়ের ৩ থেকে ১২ জন গেটকিপার প্রয়োজন। ঢাকা শহরে কিংবা জনবহুল এলাকায় থাকার কথা ১২ জন, আছেন ছয়জন করে।

এদিকে রেলের পূর্বাঞ্চলের ৩৪৩টি বৈধ ক্রসিংয়ের ১৮৯টিতে একজন গেটকিপারও নেই। পশ্চিমাঞ্চলের ৯৭৮টির মধ্যে ৭৫৭টিতে গেটকিপার নেই। দুই অঞ্চলের ৬৫৪টি লেভেল ক্রসিংয়ের পুনর্বাসন ও মানোন্নয়নে ২০১৫ সালে ৯৭ কোটি টাকার পৃথক দুটি প্রকল্প নেয় রেলওয়ে। প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বৃদ্ধিতে তা ১০০ কোটি টাকা বেড়েছে। গত বছর জুনে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছে।

রেলক্রসিংয়ে মৃতু্যর মিছিল প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, 'এখনো রেলক্রসিংয়ে যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে, রেলপথের ধারণার সঙ্গে তা বেমানান। ভবিষ্যতে রেলপথের পাশে মানুষ বাড়বে। রেলক্রসিং বাড়বে। ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে। এমনকি ঘন ঘন দুদিক থেকেই ট্রেন চলবে। ফলে সামনে আরও বিপদ। তাই রেলপথ ও সড়ক সম্প্রসারণের সঙ্গে মানুষের নিরাপত্তার জন্যও বিনিয়োগ করতে হবে।'

এর সমাধান হিসেবে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রথমত রেলপথ সারা বিশ্বেই অগ্রাধিকার পায়। এ জন্য রেলক্রসিং পর্যায়ক্রমে তুলে দেওয়া জরুরি। সে ক্ষেত্রে সড়ক উপর দিয়ে বা নিচে দিয়ে রেললাইন নিতে হবে। যে পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না, তত দিন গেট ও কর্মী দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রেলপথ, স্থানীয় সরকার এবং সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নিলে রেলপথের নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায় সেরেছে। 'এই গেটে কোনো গেটম্যান নাই, পথচারী ও সকল প্রকার যানবাহনের চালক নিজ দায়িত্বে পারাপার করিবেন এবং যে কোনো দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকিবেন'- বেশ কয়েকটি অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে এ ধরনের সাইনবোর্ড দেখা গেছে। কোথাও কোথাও আবার এমন সাবধানবার্তাও দেখা যায়, 'এই স্থানে রেললাইনের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ।' অথচ পথ দিয়ে অহরহ যানবাহন চলাচল করছে।

রেলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রেলের আইন অনুসারে লাইনের দুই পাশে ১০ ফুট করে মোট ২০ ফুট এলাকায় যে কোনো মানুষ প্রবেশ করলেই তা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। এমনকি ২০ ফুটের মধ্যে কোনো গবাদিপশু প্রবেশ করলেও তা আটকের মাধ্যমে বিক্রি করে রেলওয়ের কোষাগারে জমার নিয়ম রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়