নিউজ ডেস্ক: করোনার প্রভাবে গত বছরের ফেব্রুয়ারির পর ফিরে আসা কর্মীদের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ চাকরি হারিয়েছেন। যারা চাকরিতে ছিলেন, তাদের ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ কর্মীর বেতন কমেছে আগের চেয়ে। আর দেশে ফিরে আসার আগে নিয়মিত বেতন পাননি ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবাসী কর্মী। তবে ফেরার আগে ৯২ শতাংশ কর্মী কোথাও কোনো অভিযোগ জানিয়ে আসেননি।
মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ থেকে ফিরে আসা প্রবাসী কর্মীদের সাক্ষাত্কারের মাধ্যমে ‘অ্যাড্রেসিং সিস্টেম্যাটিক চ্যালেঞ্জেস অব ওয়েজ থেফট: বাংলাদেশী কভিড-১৯ রিটার্নিজ ফ্রম দ্য গালফ’ শীর্ষক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি অব মাইগ্রেশন (বিসিএসএম) ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) ফিরে আসা ১ হাজার ১৬০ জন প্রবাসী কর্মীর সাক্ষাত্কারের মাধ্যমে যৌথভাবে গবেষণাটি পরিচালনা করে। গবেষণা জরিপে অংশ নেয়া প্রত্যেক কর্মীর ফিরে আসার নথি যাচাই করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রভাবে গত বছরের ফেব্রুয়ারির পর ফিরে আসা কর্মীদের মধ্যে যারা চাকরিতে ছিলেন, তাদের ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ কর্মীর বেতন কমেছে আগের চেয়ে। ৬৩ শতাংশ কর্মী দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। আবার ২৯ শতাংশ কর্মী দেশে ছুটিতে এসে আর ফিরে যেতে পারেননি। যারা বাধ্য হয়ে ফিরে এসেছেন, তার ১৫ দশমিক ৬ শতাংশই কাজ হারিয়ে এসেছেন, ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ এসেছেন কাজ না থাকায়। তবে গবেষণার পর তাদের কেউ কেউ হয়তো কর্মস্থলে ফিরে গেছেন, যা এখানে আসেনি। বেতন হারানো কর্মীদের তালিকার শীর্ষে গন্তব্য দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। এরপর আছে কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, ওমান ও বাহরাইন।
প্রবাসী কর্মীরা করোনাকালে বেতন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিকসহ গড়ে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮৯ টাকা করে হারিয়েছেন। করোনা মহামারীর প্রভাবে প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন। তাদের ৮৫ শতাংশ পুরুষ কর্মী। তাদের মধ্যে পুরুষ কর্মীরা গড়ে ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ও নারী কর্মীরা গড়ে ৯৭ হাজার টাকা করে বেতন হারিয়েছেন।
গতকাল এক অনলাইন অনুষ্ঠানে গবেষণাটির তথ্য তুলে ধরে বিসিএসএমের চেয়ার ও রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সিআর আবরার বলেন, চাপ দিয়ে বিপদাপন্ন কর্মীদের দেশে ফিরতে বাধ্য করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মী পাঠানো দেশটিকে চাপ দেয়া হয়েছে তাদের কর্মী ফিরিয়ে নিতে। আন্তর্জাতিক কোনো মানদণ্ড না মেনে অনৈতিকভাবে এসব করা হয়েছে।
তিনি বলেন, অভিবাসী কর্মীদের নিরাপত্তায় কাঠামোগত দুর্বলতা আছে। মহামারীর সময় আরো চরমভাবে এ দুর্বলতা উন্মোচিত হয়েছে। কর্মীদের হারানো বেতন ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে সোচ্চার হতে হবে।
জানা গেছে, ফেরত আসা প্রবাসীদের পুনর্বাসনে সরকার নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মাধ্যমে দুই লাখ শ্রমিক ১৩ হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ অর্থ সহায়তা পাবেন। এছাড়া পুনরায় বিদেশে যাওয়ার সুযোগ, দেশে কাজের সংস্থান, ব্যবসার পুঁজি জোগান—এমন নানা সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ‘প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণের লক্ষ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সৃজনে সহায়ক প্রকল্প’ নামে এটি বাস্তবায়ন করবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
প্রকল্পে অন্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ফেরত আসা প্রবাসীদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে বেশি মজুরি পাওয়ার উপযোগী কর্মী তৈরি করা, ক্ষুদ্র ব্যবসার উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা দেয়া, কারিগরি এবং অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে দেয়া। এসব সেবা নিশ্চিত করতে একটি তথ্যভাণ্ডার করা হবে। প্রবাসীদের সব ধরনের তথ্য থাকবে সেখানে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ডিসেম্বরে করোনা শুরু হলেও বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী ফেরত আসা শুরু হয় মূলত গত বছরের এপ্রিল থেকে। ওই বছর মোট ৪ লাখ ৭৯ হাজার শ্রমিক ফেরত আসেন বিভিন্ন দেশ থেকে। সবচেয়ে বেশি আসেন সৌদি আরব, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গত জুলাই পর্যন্ত আরো ৪১ হাজার প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। এসব প্রবাসীর মধ্যে ২০২০ সালে ফেরত আসা দুই লাখ প্রবাসী শ্রমিক প্রকল্পের আওতায় সুযোগ-সুবিধা পাবেন। দেশের ৩২টি নির্দিষ্ট জেলার প্রবাসী শ্রমিকরাই এতে বিবেচিত হচ্ছেন।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে করোনা মহামারীর সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে সাড়ে তিন লাখ পুরুষ ও ৫০ হাজার নারী বাংলাদেশী অভিবাসীকে জোর করে ফেরত পাঠানো হয়। ফিরে আসা বাংলাদেশীদের ৭০ শতাংশের দেশে কাজ খুঁজে পেতে কষ্ট হয়েছে। তারা ঋণে জর্জরিত।
আইওএম বলছে, তিনটি রুটে বাংলাদেশীরা পাচার হয়ে থাকেন। রুটগুলো হলো বাংলাদেশ-তুরস্ক-লিবিয়া-ইউরোপ, বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলংকা-লিবিয়া-ইউরোপ এবং বাংলাদেশ-সংযুক্ত আরব আমিরাত-জর্ডান-লিবিয়া-ইউরোপ। সাম্প্রতিক সময়ে এসব রুটে যাওয়া বাংলাদেশীদের অনেককেই ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
বিসিএসএম ও রামরুর গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরতে আয়োজিত অনলাইন অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন মাইগ্রেশন ফোরাম এশিয়ার জনা ইউ, বায়রার মহাসচিব শামিম আহমেদ চৌধুরী, বিএমইটির সাবেক পরিচালক ড. নুরুল ইসলাম, বিএনএসকের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, ওয়ারবীর চেয়ারম্যান সাইদ সাইফুল হক, অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর প্রমুখ।
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠান ফিরে আসা ২৪৮ জন কর্মীর ওপর একটি গবেষণা চালিয়েছে। এতেও ৬০ শতাংশ কর্মীর বকেয়া বেতন রেখে ফিরে আসার কথা বলা হয়েছে। বকেয়া আদায়ের দাবি আন্তর্জাতিক আন্দোলনে নিয়ে যেতে হবে। সূত্র: বণিক বার্তা
আপনার মতামত লিখুন :