ডা. জাকারিয়া চৌধুরী: গান্ধারী’র অভিশাপে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ কিভাবে দেহত্যাগ করেছিলেন, তার কাহিনী আজ বর্ননা করব। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে । রক্তাক্ত প্রান্তরে এসে সন্তানদের মৃত্যুতে ভেংগে পড়লেন গান্ধারী । ( গান্ধারী কে ? এ প্রশ্নের উত্তর যথাসময়ে পেয়ে যাবেন )। এই ধ্বংসলীলার জন্য তিনি দায়ী করলেন ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে । তিনি তাকে অনেকবার যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন । এ বিষয়ে কোন কিছুই শুনতে চাননি দুর্যোধন । যুদ্ধ উত্তর কোন কথাই আমলে নিতে নারাজ পুত্রশোকে কাতর গান্ধারী । উল্টো অভিশাপ দিলেন, কুরু বংশের মতই নির্বিচারে ধ্বংস হয়ে যাবে শ্রী কৃষ্ণের যদু বংশ । গান্ধারীর এই অভিশাপকে আশীর্বাদ হিসেবে মেনে নিলেন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ । কারন তিনি জানতেন, যাদবদের বংশ একদিন অন্তর্কলহের বিষ বাষ্পে ধ্বংস হয়ে যাবে । ফলে গান্ধারীর অভিশাপ শ্রী কৃষ্ণের কাজকে বরং সহজ করে দিয়েছিলেন । অন্যদিকে গান্ধারীকন্যা সেই একই সময়ে শ্রী কৃষ্ণকে এই বলে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে - তিনি আর মাত্র ছ’ত্রিশ বছর বাঁচবেন এবং হয়েছিলও তাই। কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে অভিশপ্ত হবার ছত্রিশ বছর পরেই দেহ রেখেছিলেন কৃষ্ণ ।
গান্ধারীর স্থির বিশ্বাস ছিল যে, কৃষ্ণ চাইলেই এ যুদ্ধ আটকাতে পারতেন । ফলত: দাড়কায় ক্রমশই ভেংগে পড়তে লাগল যদু বংশ । কৃষ্ণের শাসনামলে যে উচ্চতায় উন্নীত হয়েছিল যদু বংশ,এ অভিশাপ বাস্তবে রুপ নিতে গিয়ে দেখা গেল তার চেয়েও অনেক বড় পতন হল পান্ডবদের ( কৃষ্ণ ও তার বাকি চার ভাই পঞ্চ পান্ডব নামেও পরিচিত ছিল )। নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় যদু বংশ । ঋষিদের সাথে পরিহাস করায় একদলা লোহার পিন্ড জন্ম দেয় কৃষ্ণপুত্র শম্ভু । রাজার পরামর্শে সেই পিন্ড গুড়ো করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয় শম্ভুর বন্ধুরা এবং পুরো ঘটনা গোপন করা হয় কৃষ্ণের কাছে । বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যাবার কারনেও যদু বংশের অনেকে প্রান হারান নিজেদের বিবাদে জড়িয়ে । তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কৃষ্ণপুত্র প্রধুন্য ও দাড়কা । যাদবদের এ হাল দেখে বনবাসে চলে যান বলরাম ও কৃষ্ণ । সেখানেই একদিন কৃষ্ণ অবলোকন করেন - বলরামের দেহ থেকে একটা সাপ বেড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে । তিনি বুঝতে পারলেন, বলরাম প্রয়ানের পরে যাত্রা করেছেন বৈকুন্ঠের পথে । এদিকে কৃষ্ণ তনয় শম্ভুর জন্ম দেয়া সেই লৌহ পিন্ডের কি হলো ? বহু চেষ্টা করেও সেই পিন্ডের পুরোটাকে গুড়ো করতে সমর্থ হয়নি শম্ভুর বন্ধুরা । এক টুকরো লোহা ঠিকই অক্ষত থেকে গিয়েছিল । সমুদ্রে ফেলে দেবার পর তা গিলে নেয় এক মাছ । সেই মাছ আবার ধরা পরে জিরু নামের এক বেদের জালে।
মাছের পেট থেকে সেই লোহা পেয়ে তা দিয়ে তীরের ফলা বানায় জিরু । একদা সেই তীর নিয়ে সে বনে প্রবেশ করে পশু শিকারের অন্বেষনে । হঠাৎ তার চোখে পরে এক অদ্ভুত পাখি, যার গায়ে আকা রয়েছে কমল ( পদ্মফুল ) চিহ্ন । লাল টুকটুকে পাখিটিকে তীরে বিদ্ধ করে জিরু । কিন্তু কাছে গিয়ে বুঝতে পারে কি সর্বনাশ হয়ে গেছে !! পাখি কোথায় ? এ যে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের পা । ঘাস পাতার আড়ালে থাকার কারনে যা সে পাখি ভেবে ভুল করেছিল ! ( হোমারের ইলিয়াডের কথা মনে আছে তো? ওই যে হেক্টর,এ্যাকিলিস,ট্রয়,হেলেন আর প্রিয়ামদের গ্রীক রুপকথা ! সেখানেও পায়ের গোড়ালি ছাড়া বাকি পুরো দেহ আমৃত্যু’র নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি দেবতাদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলেন এ্যাকিলিসের মা । ইতিহাস কি নিষ্ঠুর আর গোলক ধাধার মত ফিরে আসে । এ্যাকিলিস খুন হন পায়ের গোড়ালীতে তীর বিদ্ধ হয়ে ) শ্রী কৃষ্ণের কাছে বারবার ক্ষমা চায় জিরু । কিন্তু কৃষ্ণ তাকে বোঝান - এটা জিরুর অপরাধ নয় । এ যে ভবিতব্য । এই কথা বলে ভগবান কৃষ্ণ বনমধ্যে প্রবেশ করে বিষ্ণু মন্দিরে গিয়ে বিষ্ণুর মুর্তিতেই বিলীন হয়ে যান।
কে এই জিরু ? এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । জিরুর পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়, পুর্বজন্মে সে ছিল বানররাজ মহাবীর বালি । এই বালিকেই বশে আনতে না পেরে ( কৃষ্ণ সে সময় রাম অবতারে লংকা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ) কৃষ্ণ অত্যন্ত অন্যায় এবং নিষ্ঠুরভাবে ঝোপের আড়াল থেকে বালিকে হত্যা করেন এবং বালির ছোটভাই সুগ্রীবকে রাজত্বের লোভ দেখিয়ে নিজ দলে ভেড়ান । ঠিক একই কাজ করেছিলেন বিভীষনের বেলাতেও । লংকা অভিযানের পুর্বেই বিভীষনকে তিনি ভবিষ্যত লংকার রাজা বানিয়ে দেন। ইতিহাস সত্য এবং তা নিষ্ঠুরভাবেই ফিরে আসে । কর্মফলে পরজনমে সেই বালি’র ( জিরু ) হাতেই বলি হলেন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ । আর গান্ধারীর অভিশাপেই কৃষ্ণের পত্তন করা দাড়কা নগরী আরব সাগরে বিলীন হয়ে যায়।
সাব্বে সাত্তা সুখীতা ভুবন্তু - জগতের সকল প্রানী সুখী হোক, মংগল লাভ করুক ।
ভগবান বুদ্ধের অমন দীক্ষা থেকে শিক্ষা নিয়ে যাবা বৌদ্ধ হয়েছিলেন, খুব করে বলতেন ‘প্রানী হত্যা মহাপাপ’ সেই ভিক্ষুদের দল আরাকান এবং উইঘুরে কি করেছে বলব নাকি কি করেনি তার তালিকা দেব। সেখানে ইথনিক ক্লিঞ্জিং এর শিকার হয়েছে আগে পরে মিলে লাখের উপরে মানুষ। বাস্তুহারা হয়েছে কমপক্ষে কুড়ি লক্ষ। আমাদের দেশে-ই তো আছে ১১ লক্ষ রোহিংগা। মানবতার ফেরিওয়ালাদের দল তখন কই ছিল ? এ্যামনেস্টি, জাতিসংঘ, আম্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজল্যান্ড সহ আন্তর্জাতিকভাবে গত প্রায় দুই মাসে মিয়ানমার নিয়ে লংকাকান্ড চলছে । কারন কি ? আসল কারন হচ্ছে জান্তা সরকার একটা মেয়েকে গুলি করে হত্যা করেছে। আচ্ছা কেউ কি হিসেব নিয়েছে ১৯৭৮ সাল থেকে আজতক কতলক্ষ মুসলিম নারী বার্মিজ সেনাদের সন্তান জন্ম দিয়েছেন ? তারা বিচার দিতে গেলে বিচারের আশা দুরাশায় পরিনত হইয়েছে যুগ যুগ ধরে। কোথাও কেউ নেই, কোথাও কেউ ছিলও না তাদের । আরাকানে তারা বাংগালী এবং বার্মিজ সরকার তাদেরকে নাগরিক মর্যাদা দেয়না । তাদের সেটেমমেন্ট কি আমরা করেছিলাম ? ভোগ পোহাচ্ছি কেন তবে ? স্ত্রী হয়েছি বলে। গাট না থাকলে স্ত্রী হলেই বা কি !!
আপনারা কি জানেন, জম্মু-কাশ্মিরের অবস্থা !! সেখানে প্রতিদিন কতগুলো মেয়ে ধর্ষনের শিকার হয় ? এদের বেলায় কোনো ডাটা কারো কাছে নেই। সব কিছু চলে যাচ্ছে ‘ইসলামো ফোবিয়া’র ডেফিনেশনে। ইসলামো ফোবিয়া, ইসলামো ফোবিয়া……… এই কচকচানি চলছে সেই ১/১১ হামলার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে জংগী সাজানোর নাটক টা এতো প্রকট হয়ে উঠেছিল এক সময় যে, ইন্ডিয়ায় স্বামীর বাড়ি গিয়ে একটা সিম জোগাড় করা যায়নি তিন দিনেও। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানীদের জন্য এ নিয়ম। এনি টাইম উই মে বিকাম টেররিস্ট। তারা সিলেবাস ধরে মুসলিম মানে-ই টেররিস্ট পড়ে বড় হয়। বাংলাদেশের নাম জানেনা অধিকাংশ ভারতবাসী। তাদেরকে বাংলাদেশ নিয়ে পড়ানোর প্রয়োজন হয় না। যে মেহমান বাংলাদেশে আসছেন বলে এত খুশির জোয়াড় সেই চা ওয়ালার সুত্র ধরে-ই গোধরা রেলওয়ের গনহত্যা হয়েছিল। এক চা ওয়ালা আরেক চা ওয়ালার সাগরেদ বনেছিল। আর মুসলিমদের নিয়ে কি বলব ? দুনিয়ার সবচে নির্বোধ, অশিক্ষিত, লোভী একটা সম্প্রদায় যাদের মানবতার হাত সমাজকে দেখতে দেয়া হয়না। তাদের বানানো খারাপ চরিত্রগুলোর মধ্যে দিয়ে-ই ঘুরে ফিরে চলতে দেখা যায় মুসলিমদের যারা কোনো না কোনো অপরাধে জড়িত।
মোরাল:
ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত এমনই এক বিষাক্ত ফলা যা থেকে রেহাই পায়নি কেউ । না অতীতে না কখনো । না সাধারনে,না দেবতারা। সবাই-ই নিষ্ঠুর পরিণতি ভোগ করেছে।
আমার মাথায় একটা প্রশ্ন প্রায়ই ঘুরপাক খায় । একটা সত্য কিংবা একটা সত্য মোরালকে কত হাজার গল্পে স্পষ্ট করে তুললে এদেশের মানুষের বোধোদয় হবে ? কিও বাবু’রা? বুঝো নাকি না বুঝার মত সময় ক্ষেপনই কোন কৌশল ? আজ মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন - আলোচনার সময় শেষ। এরও আগে সকালে একটা স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছিলাম - অন্যায্য সময় ক্ষেপন এমন আহামরি কোন কৃতিত্ব নয় । সময় ক্ষেপন যুদ্ধের সম্ভাবনাকেই কেবলমাত্র প্রকট করে তুলতে পারে,শান্তি দূর বনবাসে চলে যায়।
এখানে যা যা গীত গাইলাম, তার প্রতিটা শব্দই বর্নে বর্নে সাজানো সত্য । আশা করি,শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।
ডা. জাকারিয়া চৌধুরী: ডেন্টাল সার্জন, কলাম লেখক
আপনার মতামত লিখুন :