শিরোনাম
◈ যুক্তরাষ্ট্র কঠোর হচ্ছে ‘বার্থ টুরিজম’ বন্ধে ◈ আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন, আইন মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি ◈ যেসব অঞ্চলে সকালের মধ্যে ঝড় হতে পারে ◈ কুয়েটের ভিসি-প্রো-ভিসিকে প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি ◈ ভারত কি পাকিস্তানে সিন্ধু নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ করতে পারবে? ◈ আ.লীগ নিষিদ্ধের কথা বললে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গির দোহাই দেয় সরকার: শহিদি সমাবেশে সারজিস আলম ◈ কৃষি বিপ্লবের হাতছানি, ৪২০০ টাকার ন্যানো সার মিলবে ২৩০ টাকায়! ◈ পোপ ফ্রান্সিসের শেষকৃত্যে যোগ দিতে ভ্যাটিকানে অধ্যাপক ইউনূস ◈ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের মহড়া, এলাকায় আতঙ্ক ◈ আইপিএলে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ, প্রমাণ করতে ভিডিও নিয়ে হাজির পাকিস্তা‌নের ক্রিকেটার

প্রকাশিত : ২০ অক্টোবর, ২০২০, ০৫:১৪ সকাল
আপডেট : ২০ অক্টোবর, ২০২০, ০৫:১৪ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস

।। মাহবুবুর রব চৌধুরী।। সোনার বাংলায় ঐতিহাসিক অপরিহার্যতায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস পাঠ আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে এবং বাংলাদেশি কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং মন ও মানস গঠন প্রক্রিয়ায় তা গভীরভাবে সম্পৃক্ত। অতীত গৌরব, বর্তমান গর্ব এবং সুন্দর সোনালী ভবিষ্যৎ গঠনে ইতিহাসই হচ্ছে একটি জাতির সামনে জীবন্ত প্রেরণা। তাই বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস চর্চা এবং গবেষণা আমাদের জন্য অতীব জরুরি।

১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয় থেকে ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাহর ইতিহাস এবং ১৯৪৭-এ ভারত বিভক্তি থেকে পরবর্তী পূর্ব-পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় - এই সমগ্র সময়টি আমাদের গর্বিত ইতিহাসেরই অংশবিশেষ।

বাংলায় ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয় থেকে মুসলিম শাসনের শুরু। সেই থেকে আজকের ২০২০ সাল পর্যন্ত ৮১৬ বছর এবং ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাহর পলাশীর প্রাঙ্গণে ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধে পরাজয় এবং অতপর ১৯৪৭ পর্যন্ত ১৯০ বছর ইংরেজ শাসন, এই সময়কাল বাদ দিলে ৬২৬ বছর বাংলা ছিলো মুসলিম শাসনাধীন। এর মাঝে কিছু সময়কাল দিল্লী ও ইসলামাবাদকেন্দ্রীক শাসনের অধীনেও বাংলা শাসিত হয়েছে।
যখন ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করেন, দিল্লীতে তখন মোহম্মদ ঘোরী রাজবংশীয় শাসন বলবৎ। আর ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাহর সময়ে দিল্লীতে ক্ষমতাসীন ছিলেন মোগল সম্রাট আলমগীর শাহ, যার সময়কাল ১৭৫৪ থেকে ১৭৫৮ সাল পর্যন্ত।

এক্ষেত্রে বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন ভারতে শেষ মোগল সম্রাট, যার সময়কাল ১৮৩৭ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত। ১৮৫৭-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ তথা মহান সিপাহী বিদ্রোহের পর এই উপমহাদেশ থেকে ৩১৫ বছরের মোঘল শাসনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। বাংলায় বৌদ্ধ ও পাল রাজত্বের পর ১০৭০ সালে হেমন্ত সেনই হিন্দু সেন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সেনরা ছিলেন কর্ণাটকের হিন্দু ব্রাহ্মণ। দক্ষিণ ভারত থেকে ভাগ্য অন্বেষায় এসে তারা সংস্কৃত ভাষাকে রাজভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। বাংলায় দ্রাবিড়, পৌত্তলিক, হিন্দু, বৌদ্ধ, পাল এবং পালের পর পুনরায় শুরু হিন্দু সেন শাসন। অতপর ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের সঙ্গে মুসলিম শাসন সূচিত।

সেই থেকে এ পর্যন্ত ইতিহাসে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমেই মূলত রাজ্যজয়ের কাহিনী বিবর্তিত। হত্যা ও ধ্বংস, যুদ্ধের একটি সাধারণ চিত্র এবং সর্বত্রই কম-বেশি তা ঘটেছে; অর্থাৎ একই চিত্রেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ইতিহাসের এই পথ-পরিক্রমায় ইখতার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি ১২০৪ সালে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সেনানী নিয়ে বাংলায় লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া জয় করেন। যুদ্ধের আভাস পেয়ে রাজা লক্ষণ সেন নদীয়া থেকে নৌকাযোগে পূর্ব বাংলায় পালিয়ে যান। ফলশ্রুতিতে বখতিয়ার খিলজি এক প্রকার বিনা যুদ্ধেই নদীয়া জয় করেন। তবে সেই বিজয়ে যুদ্ধের ধ্বংস ও রক্তপাত ছিল না।

তথাপি বখতিয়ার খিলজিকে অনেকেই প্রমাণবিহীন নানা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের জন্য দায়ী করেন, যখন তিনি নদীয়া দখল করেছিলেন। এছাড়া তিনি বর্তমান বাংলাদেশ সীমানা অভ্যন্তরে পদাপর্ণ করেননি, স্বভাবতই তাতে প্রশ্ন উঠবে- কুমিল্লার ময়নামতির শালবন বৌদ্ধ বিহার এবং পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার কে বা কারা কখন ধ্বংস করেছিলো? সেটি ইতিহাসেরই প্রশ্ন বৈ কি? উত্তরটি হলো সোমপুর বিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করেছিলেন বিষ্ণুভক্ত হিন্দু রাজা জাতবর্মা। আর কুমিল্লার ময়নামতির শালবন বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করেছিলেন হিন্দু জাত ব্রাহ্মণরা। তারা সেগুলো ভুলক্রমে ধ্বংস করেননি, বরং জেনে শুনেই ধ্বংস করেছিলেন। বৌদ্ধ পাল রাজত্বেরও পতন হয় হিন্দু সেন বংশের কবলে পড়ে।

সেন রাজত্বকালে বাঙালি বৌদ্ধ এবং নিম্ন বর্ণের স্থানীয় হিন্দুরাও ছিল এক নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। সেন বংশীয় হিন্দু রাজাদের অত্যাচারে কিছু বাঙালি বৌদ্ধ প্রানরক্ষার্থে নেপাল, তিব্বত, মিয়ানমার ও শ্রীলংকায় পালিয়ে যান। ওই সময় তাদের হাতেই বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ নেপাল, ভুটান, তিব্বত ও সিকিমে ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধদের অনেকেই পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তারা সময়ের বিবর্তনে বাঙালি মুসলিমে পরিণত হন। এতে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা হয়ে ওঠে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলায়। পরিবর্তনের এ ধারাবাহিকতা অনেকে সহজে মেনে নিতে পারেননি। কিছু বৌদ্ধ মুসলিমদের এ বিজয়কে ক্রোধ ও হিংসার দৃষ্টিতে দেখেছেন। ইতিহাসের শিক্ষার বিপরীতে এবং বুদ্ধের অহিংস বাণীর বিপরীতে মুসলমানদের বিপক্ষে তারা অকারণে বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করতে থাকেন। অবাক করা কথা, হিন্দুদের নির্যাতনে বার্মায় পালিয়ে যাওয়া বৌদ্ধদের ক্ষুদ্র একটি অংশ হিন্দুদের পাঁচন খেয়ে মগের মুল্লুকে মুসলিম বিরোধী অপপ্রচার শুরু করেন।

প্রকৃত পক্ষে ও ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি বৌদ্ধদের সঙ্গে বাঙালি মুসলিমদের কোন বিরোধ ছিল না। তবে মগদের সঙ্গে এবং বার্মিজ বৌদ্ধদের সঙ্গে বঙ্গের মানুষের নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। মগরা পর্তুগিজদের মতো এবং কখনও তারা পুর্তগিজদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এসে লুন্ঠন করতো, এমনকী মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করেছে। বাংলায় বার্মিজ বৌদ্ধ মগ, খ্রিস্টান পুর্তগিজ জলদস্যু এবং হিন্দু মারাঠি বর্গীদের আক্রমণ, হত্যা, লুন্ঠন, অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ছিল স্বভাবতই বিক্ষুব্ধ। জনগণের নিরাপত্তা বিধানে মুসলিম শাসক, সুলতান ও নবাবেরা ছিলেন অকুতোভয়, দৃঢ়চেতা ও আপোষহীন এবং গণমানুষের শ্রদ্ধাভাজন ও গণমানুষের ত্রাণকর্তা। জনগনের কল্যাণ ও নিরাপত্তা বিধানে ছিলেন সদা সচেষ্ট। এই উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো বাংলার বুকে সাধারণ মানুষের মাঝে ইসলামকে ধারণে বিপুলভাবে উদ্বুদ্ধ করে তোলে, সেটি ইতিহাস স্বীকৃত।

এখানে বাংলায় মুসলিম শাসনের বিভিন্ন পর্বের রাজবংশীয় ধারাবাহিকতার একটি চিত্র তুলে ধরা হলো, যা মোহাম্মদ ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি রাজবংশ থেকে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাহ পর্যন্ত বিস্তৃত; যার সময়গত পরিধি ৫৫৩ বছর, অর্থাৎ ১২০৪ থেকে ১৭৫৭ সাল। সে হিসেবে বাংলায় রাজ্য কেন্দ্রীক শাসন হচ্ছে- ১. মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি রাজবংশ: ১২০৪-১২২৭ সাল। ২. মামলুক সুলতানদের শাসন আমল: ১২২৭-১২৮১ সাল। ৩. বলবান শাসন আমল: ১২৮১ -১৩২৪ সাল। ৪. তুগলগ আমল বা তুগলগদের নিয়োগ প্রাপ্ত বাংলার শাসন আমল: ১৩২৪-১৩৩৯ সাল। ৫. ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বংশীয় আমল (বাংলার স্বাধীন শাসক): ১৩৩৯-১৩৫২ সাল। ৬. সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ শাসন আমল: ১৩৫২-১৪১৪ সাল। অর্থাৎ (ক) সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ: ১৩৫২-১৩৫৮; (খ) সিকান্দার শাহ: ১৩৫৮-১৩৯০; (গ) গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ: ১৩৯০-১৪১১; (ঘ) সাইফুদ্দিন হামজা শাহ: ১৪১১-১৪১২; (ঙ) শাহাবুদ্দিন বাইজিদ শাহ: ১৪১২-১৪১৪ এবং (চ) জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ: ১৪১৫-১৪৩৩। লক্ষণীয়, রাজা গণেশের বড়পুত্র যদু গনেশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ নাম ধারণ করেছিলেন। (ছ) শামসুদ্দিন আহমদ শাহ: ১৪৩৩-১৪৩৫; (জ) নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ: ১৪৩৫-১৪৫৯। (ঝ) রুকুনুদ্দীন বারবাক শাহ: ১৪৩৫-১৪৭৪। (ঙ) শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ: ১৪৭৪-১৪৮১। (ট) জালালুদ্দিন ফাতে শাহ: ১৪৮১-১৪৮৭। ৭. ইলিয়াস শাহ বংশের পালক পুত্র হাবশী আফ্রিকানদের আমলকে হাবশী শাসনামল হিসেবে ইতিহাসে চিত্রিত। হাবশী শাসনামল ১৪৮৭ থেকে ১৪৯৪ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। পরবর্তীতে মোঘল সুবেদার ও বাংলা গভর্নররা ক্ষমতায় ছিলেন ১৫৬৫-১৭১৭ সাল পর্যন্ত। এছাড়াও বাংলার স্বাধীন নবাবরা ক্ষমতায় ছিলেন ১৭১৭-১৭৫৭ সাল পর্যন্ত; অর্থাৎ নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাহ পর্যন্ত। তাদের মাঝে নবাব মুর্শিদ কুলি খান ১৭১৭ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় স্বাধীন নবাবী শাসনামল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭০০ সালে দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে বাংলায় দেওয়ান বা খাজনাদার হিসাবে নিয়োগ দেন। কিন্তু নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতা গুণে অল্প সময়েই তিনি নিজাম বা সুবেদার বা গভর্নর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তার এই পদোন্নতিতে অনেকেই হিংসা পরায়ণ হন এবং কৌশলে তারা সম্রাটের নাতি আজিম উস শান-কে তার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তোলেন। এতে কুলি খানের জীবন সংকটপূর্ন হয়। সম্রাট আওরঙ্গজেব বিষয়টি অনুধাবন করে নাতি আজিম উস শান-কে পাটনায় বদলি করেন এবং নাতির নামে পাটনার নাম আজিমাবাদ হিসেবে নামকরণ করেন এবং মুর্শিদ কুলি খান-কে ঢাকা থেকে মুকসুবাদে বদলি করেন। পরে এই মুকসুবাদই নবাব মুর্শিদ কুলি খান নিজের নামে মুর্শিদাবাদ হিসেবে নামকরণ করেন এবং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী হিসেবে নবাবী আমলের প্রচলন করেন। এই রাজধানীটি বাংলার পুরনো রাজধানী নদীয়া থেকে খুব দূরবর্তী নয়। তাতে সেখানে পর্যায়ক্রমিক শাসনামল হচ্ছে- (ক) মুর্শিদ কুলি খান: ১৭১৭-১৭২৭; (খ) সরফরাজ খান: ১৭২৭-১৭২৭; (গ) সুজা উদ দৌলাহ: ১৭২৭-১৭৩৯; (ঘ) নবাব আলী বর্দি খাঁ: ১৭৪০-১৭৫৬ এবং (ঙ) নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাহ: ১৭৫৬- ১৭৫৭ সাল।

প্রসঙ্গত বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস পর্যালোচনায় আরাকান, বার্মা এবং রোহিঙ্গা একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়, যা মূলত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় প্রায়ই বিস্মৃত। বাংলায় ইসলামি প্রভাব ও মুসলিম শাসনের পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনার স্বার্থে এখানে সংক্ষিপ্ত আঙ্গিকে আরাকান, বার্মা ও বাংলার সংক্ষিপ্ত একটি বর্ণনা তুলে ধরা হলো। ১৪০৬ সালে মুসলিম বাংলায় ইলিয়াস শাহ রাজবংশের আমলে সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের দরবারে আরাকান রাজা নরমিখলা রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। নরমিখলা অর্থাৎ ‘মিন স মন’ এবং মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ, এই তিনটি নামেই তিনি ইতিহাসে পরিচিত। তিনি বার্মার আভা রাজা মিন খং-এর কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেশত্যাগ করেন। আভা রাজা মিন খং-এর কবল থেকে আরাকানের স্বাধীনতা পুণরুদ্ধারে নরমিখলা সুলতান আজম শাহের সাহায্য চান। সুলতান তাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। ২৪ বছর বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে থাকার পর ১৪৩০ সালে সুলতান মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শাহ’র শাসনামলে বাংলার ৩০ হাজার মুসলিম সেনার সাহায্যে আরাকানের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। দখলদার বার্মিজ বিতাড়িত করে নরমিখলা নতুনভাবে আরাকানের শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। নরমিখলার এই নতুন আমল স্বাধীন মারাউকি বা ‘মারাউকো’ আমল হিসাবে পরিচিত। স্বাধীন আরাকান মারাউকি আমল: ১৪৩০-১৭৮৫ পর্যন্ত অর্থাৎ ৩৫৫ বছর স্থায়ী ছিল। এতে আরাকানের একটি গৌরবময় ইতিহাস জড়িত। যেমন- (১) প্রাক্ ঐতিহাসিক আমল। (২) ধানি ওয়াদি আমল: খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দ। (৩) ভেসালি বা ওয়াথালী আমল: ৩০০- ৮৯৪ পর্যন্ত। (৪) এরপর তিন পর্বের লেমরু আমল: ৫১২ বছর, অর্থাৎ ৮৯৪- ১৪০৬ সাল। (ক) প্রথম লেমরু স্বাধীন আমল: ৮৯৪-১০৪৩ সাল। (খ) দ্বিতীয় অর্ধ পরাধীন লেমরু আমল: ১০৪৪-১২৮৭ সাল। এ সময় ১০৪৪ সালে বার্মার প্যাগান রাজা আনারাথার আরাকান আক্রমণ এবং খাজনা প্রদানের শর্ত আরোপিত হয়। (গ) তৃতীয় লেমরু আমল: ১২৫৫- ১৩০৬ সাল। এতে লেমরু শাসনের শেষ বা তৃতীয় পর্বের শেষ রাজা ছিলেন ‘মিন স মন’। উল্লেখ্য, মধ্যযুগে আরাকান রাজসভা ছিল বাংলা সাহিত্য চর্চার পাদপীঠ, অর্থাৎ যার মুসলিম প্রভাব ছিল সুবিদিত। বাস্তবে আরাকান ‘আররুকন’ থেকে আরাকানের উৎপত্তি। রুকন অর্থ স্তম্ভ। ইসলামের পাঁচ রুকন বা ‘আররুকন’। ‘একখ আব’ বা ‘এক আব’ হচ্ছে আরবি শব্দ, যার অর্থ জলাধার। ‘আকিয়াব’ হচ্ছে নদীর পাড় বা জলের ধারে। যেমন- ‘পাঞ্জাব’ বা ‘পান্জ আব’ হচ্ছে পাঁচ নদীর পাড়। তেমনি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি সৌভাগ্য বা আরবি ‘রহমত’ থেকে উৎসারিত। এভাবে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, কৃষ্টি, শিল্প ও সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাসের একটি সমৃদ্ধ সূত্রবন্ধন সুদূর অতীত অবধি অঙ্গাঅঙ্গী জড়িত এবং তা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তা স্ট্রাটেজির ক্ষেত্রে ছিল গুরুত্বপূর্ন আউটপোস্ট বা দিগন্ত।

এই প্রেক্ষাপটে বলা প্রয়োজন যে, নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাহ ১৭৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন শিক্ষানুরাগী ও ধার্মিক মাতা আমেনা বেগম ও পিতা জয়েন উদ্দিন আহমেদ খানের পরিবারে। নানা নবাব আলী বর্দি খানের তত্ত্বাবধানে বাংলার ভবিষ্যত নবাবকে দেশ পরিচালনায় গড়ে তুলতে প্রাসাদেই চলে সব আয়োজন এবং সেভাবেই গড়ে ওঠেন তিনি। পরবর্তীতে ১৭৪৬ সালে তিনি নানার সঙ্গে মারাঠীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানেও অংশগ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে নানা নবাব আলী বর্দি খানের কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় নাতি সিরাজ-উদ্-দৌলাহ ১৭৫২ সালে উত্তরাধিকার হিসেবে ক্ষমতাসীন হন। তিনি নানা নবাব আলী বর্দি খানের মতোই দেশপ্রেমীক, প্রজা হিতৌষী ও অসীম সাহসী নবাব ছিলেন। তাকে ছাড়া বাংলার ইতিহাস অকল্পনীয় ও অপূর্ণাঙ্গ। আজীবন তিনি তার বুদ্ধি, বিবেক এবং শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন; এমনকী জীবন দিয়ে তার প্রমাণ রেখেছেন। অথচ ক্ষমতাসীন হয়েই বুঝতে পারেন, তিনি শত্রু পরিবেষ্টিত। প্রাসাদে খালা ঘসেটি বেগম ও সেনাপতি মীর জাফর আলী খান এবং বাইরে জগৎ শেঠ, উমি চাঁদ ও রায় দুর্লভ। এছাড়া কলকাতায় ইংরেজ ও পশ্চিমে মারাঠা। এই কঠিন সময়ে মা আমেনা বেগম, স্ত্রী লুৎফুন নেছা এবং দক্ষিণহস্ততুল্য মীর মর্দন বা ইতিহাসের মীর মদন ও বন্ধু মোহন লাল, যারা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই তরুণ নবাবের প্রতি আস্থাশীল ও সঙ্গে ছিলেন। অথচ পলাশীর চক্রান্ত ও বিশ্বাসঘাতকতার যুদ্ধ শেষে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাহর পরাজয় ঘটে। আর এই পরাজয়ের সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে ভারতের পরাধীনতার পাশাপাশি মুসলিম শাসনেরও অবসান ঘটে। এরপর শুরু হয় ব্রিটিশ রাজ আর পরাধীন ভারতের ইতিহাস। ১৭৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভ থেকে ১৮৫৮ সাল অবধি লর্ড ক্যানিং এবং ১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন পর্যন্ত মোট ১৯০ বছর চলে ওই শাসন। মুসলমানদের কাছ থেকে সপরিকল্পনায় শাসন ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার বিষয়টি ইংরেজরা সাধন করেছে বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের কুটিলতায়। আর ওই কূকর্মে ইংরেজদের সহযোগি ছিল উগ্রপন্থী হিন্দুরা, যাদের তারা স্থানীয় দালাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। পক্ষান্তরে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের প্রতিটি সুযোগই মুসলমান এবং দেশপ্রেমিক হিন্দু সমাজ নানাভাবে কাজে লাগাতে সচেষ্ট ছিল।

তা সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, স্বাধীনতাকামী ও বিদ্রোহী মুসলিম মানস ধ্বংসে ইংরেজ কোনো প্রকার সুযোগ ছাড়েনি। তারা বাংলার মুসলিমদের অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংসে নীলকর ও নীলচাষ থেকে শুরু করে ভুঁইফোঁড় হিন্দু দালালদের মুসলিমদের উপর জমিদার হিসেবে বসিয়েছে। তাতে শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনীতিতে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ে। অথচ মুসলিম শাসনামলে বাংলায় ‘গরিব মুসলিম’ কল্পনাটি ছিল অচিন্তনীয়। পক্ষান্তরে ইংরেজ শাসনে বাংলায় ‘ধনী মুসলিম’ খুঁজে পাওয়াটাই ছিল অকল্পনীয় ও অচিন্তনীয়। ইংরেজ শাসনামলে শোষণ ও শাসনের স্বার্থে ইংরেজরা সারা ভারতে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ অর্থাৎ বিভাজন ও শাসন নীতি চালু করে, যার বিষবাষ্পে এখনও মানুষ আস্তাকুড়ে নিমজ্জিত। এমনকী ধর্ম ও বর্ণবাদকে উস্কে দেয়ার বিভেদটি আজো সমাজের সুগভীরে প্রোথিত। সেজন্য ইতিহাসের স্বার্থে ঐতিহাসিক সত্যটি তুলে ধরা অত্যন্ত প্রয়োজন।

লেখক পরিচিতি: মাহবুব রব চৌধুরী, গবেষক ও সমাজচিন্তক এবং টরন্টোয় বাংলাদেশ সম্মেলন ফোবানা ২০০০-এর আহবায়ক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়