সারওয়ার তুষার: ইতিহাস, ধর্ষণ , ‘ইজ্জত’ ও ‘লজ্জা’……
সারওয়ার তুষার:: মুক্তিযুদ্ধের যে বয়ান আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রধান বয়ান হিশেবে জায়গা করে নিয়েছে, তা কেবল জাতীয়তাবাদীই নয় ; সেই বয়ান পুরুষতান্ত্রিক বয়ানও বটে। অর্থাৎ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আক্ষরিক অর্থেই 'His-Story'; 'Her-story' হয়ে উঠতে পারেনি।
এমনিতে সারা দুনিয়া জুড়েই আধিপত্যশীল ইতিহাস-রচনার অন্যতম নারীবাদী সমালোচনা হচ্ছে : যাকে তুমি বলো 'History', তা আসলে 'হার-স্টোরি'ও বটে। এই বইটা সেই ধারারই একটা গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারভেনশন।
কিন্তু সেটা ব্যাটা ছেলেরাই অস্ত্রে হাতে দেশ রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নারীরা করেনি ; একে ভুল প্রমাণ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর সক্রিয়তা, নারীদের অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার নজির এই বই তুলে ধরেছে বলে নয়। মুক্তিযুদ্ধের মর্দ জাতীয়তাবাদী বয়ানে একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক এই দেশের নারীদের ধর্ষণের শিকার হওয়ার নৃশংস ঘটনাকে যে বয়ানে বিধৃত করা হয়েছে, সেই বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নারীর কর্তাসত্তা ও এজেন্সির প্রতিষ্ঠা এবং খোদ ধর্ষণেরই নতুন বয়ান হাজির করার মাধ্যমে।
সায়েমা খাতুন আমাদের জানাচ্ছেন, "মুক্তিসংগ্রামের প্রথম পর্বে এবং মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে নারীকে সম্মুখসারির প্রতিরোধ-যোদ্ধার চেহারায় দাঁড় করালেও যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই তা প্রতিস্থাপন করে প্রধানত ধর্ষিত-ভগ্ন-মৃত ভিক্টিম এর চেহারায়। পরিবেশনের এই প্রক্রিয়ায় ইতিহাস থেকে তাদের গায়েব ও গুম করে দেয়া হয়েছে।"
প্রশ্ন হচ্ছে, যুদ্ধের অংশ হিশেবে পুরুষ যোদ্ধার অংশগ্রহণ, শহিদ হওয়া কিংবা অঙ্গহানী ঘটা যে অর্থে যুদ্ধের বীরোচিত বয়ানের অংশ, সেই অর্থে ধর্ষণ কেন 'লস' বা ক্ষতির অংশ? কেন বীরোচিত অংশ নয়? কেন ও কীভাবে 'নারীর অ্যাক্টর হিশেবে পতন ঘটল তার ভিক্টিম দশায় বিস্মরণের অতল গহবরে' ?
১৯৭১ এর মুক্তিসংগ্রামে নারীরা জাতীয় ইতিহাসের মাত্র দু'টি বিশেষ মুহুর্তে বিস্মরণের গহবর থেকে দৃশ্যপটে ভেসে উঠেছে :
এক. অতীতে-যুদ্ধাক্রান্ত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য আন্তর্জাতিক মনোযোগ, সমর্থন, সহানুভূতি ও সাহায্য লাভের তাগিদে এবং
দুই. বর্তমানে-যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিকে পোক্ত করা ও ন্যায্যতা দেবার জন্য। (সায়েমা/২০১৫)
এ বাদে গত প্রায় পাঁচ দশকে (প্রথমদিকে 'বীরাঙ্গনা' উপাধি ঘোষণা, গর্ভপাত ও দত্তকদানের ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের স্বল্পমেয়াদী কিছু কর্মসূচি বাদে) আমাদের 'মূলধারার' ইতিহাসে, রাষ্ট্র ও সমাজে জেনোসাইডের অংশ হিশেবে ধর্ষণ ও তার ফলাফলকে মোকাবেলা করা হয়নি। 'সতীত্ব' ও 'ইজ্জত' হারানো হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান দুর্ভাবনা। 'লজ্জা' হয়েছে প্রধান অনুভূতি।
মুক্তিযুদ্ধের মর্দ ইতিহাস পরিবেশনায়, যুদ্ধে নারীর অবদান ও আত্মত্যাগ বলতে বোঝানো হয়েছে প্রধানত দু'ধরনের হারানো: (ক) পাকবাহিনীর হাতে 'ইজ্জত' বা 'সম্ভ্রম' হারানো, (খ) পিতা-স্বামী-সন্তান-ভাই হারানো। (সায়েমা/২০১৫)
অর্থাৎ নারী যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত পুরুষের সাথে তার সম্পর্কের মাধ্যমে। যুদ্ধের যোদ্ধা, সংগ্রামে সংঘটিত নানাবিধ দেনাপাওনার যে কর্তা, আত্মত্যাগী ও অধিকারী সেই 'সেলফ' (self), পুরুষ। নারী কেবল ভায়া-মিডিয়া। (সায়েমা/২০১৫)
যুদ্ধ যত অগ্রসর হয়েছে , সরকারি-বেসরকারি ভাষ্যে, লেখালেখিতে, প্রচারমাধ্যমে নারীর সক্রিয় সংগঠক যোদ্ধা ইমেজ প্রতিস্থাপিত হয়েছে ভিক্টিম এর নিষ্ক্রিয়, মৃত, অর্ধমৃত, জীবন্মৃত দেহ ও সত্তা নির্মাণের মাধ্যমে। (সায়েমা/ ২০১৫)
নারী-পুরুষের মুক্তির অভিন্ন আকাংঙ্ক্ষা পরবর্তী ইতিহাসের পরিবেশনায় বিবর্তিত হয়েছে এমনভাবে ; যেখানে পুরুষ যুদ্ধের বীর, ইতিহাসের কর্তাসত্তা এবং নারী 'ইজ্জত হারানো', 'কলঙ্কিত' ও লজ্জিত অধস্তন সত্তা। এ যেন নারীর নিজের যুদ্ধ নয়, পুরুষের যুদ্ধে নারীর 'ক্ষতি'। তাদেরকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী হাহাকার, আবেগ এমনকি গর্বের বয়ানের মধ্যে এই মনোভাব কেবল প্রচ্ছন্নই নয়, রীতিমতো প্রকাশ্য।
সূত্র : সায়েমা খাতুন (২০১৫), মুক্তিযুদ্ধের HIS-STORY : ইজ্জত ও লজ্জা ; দৃক বুক্স, ঢাকা।