ডেস্ক রিপোর্ট : [২] নির্বাচনের প্রায় সাড়ে তিন মাস পর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত দুই মেয়র দায়িত্ব নিয়েছেন। এর মধ্যে গত ১৩ মে (বুধবার) দ্বিতীয় মেয়াদে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছেন মো. আতিকুল ইসলাম। আর গতকাল শনিবার দায়িত্ব নিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
[৩] ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, রাস্তা সংস্কার ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যানজট নিরসন ও বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা দূর করার চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি করোনার কারণে আর্থিক সংকটে পড়া রাজধানীর মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বায়ুদূষণ কমিয়ে বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলা দুই মেয়রের সামনে নতুন ও অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
[৪]এছাড়া দুর্নীতিবাজ ও তোষামোদকারী কর্মকর্তাদের লাগাম টেনে ধরাটাও নতুন মেয়রদের জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে থমকে গেছে ঢাকার দুই সিটির রাস্তাঘাট ও খাল উন্নয়নকাজ। কাজগুলো দ্রুত শেষ না হলে কাটা ও খুঁড়ে রাখা রাস্তার কারণে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে নগরবাসীকে। যেহেতু সামনেই বর্ষা মৌসুম তাই ঢাকার দুই সিটির নিজস্ব ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহারের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে নগর উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনায় জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
[৫]নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে নগরীর মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জোর দিতে হবে। ময়লা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ড্রেন ও খাল অবমুক্ত করতে হবে। ভবন সুরক্ষিত কি না সেটাও যাচাই-বাছাই করতে হবে। জনচলাচলের জন্য পরিবেশবান্ধব দূষণমুক্ত গণপরিবহন চালু এবং কঠিন ও তরল বর্জ্যরে যথাযথ ব্যবস্থাপনা করতে হবে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী প্রথা ফিরিয়ে আনতেও বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, ‘সিটির ক্ষমতা মেয়রকেন্দ্রিক কুক্ষিগত না থেকে কাউন্সিলর-নির্ভর হতে হবে। আ লিক পরিকল্পনা হাতে নিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে হবে। কিন্তু ইতোপূর্বে দেখা গেছে কাউন্সিলদের গুরুত্ব দেয়া হয় না।’
[৬]একটি সুন্দর, সচল ও আধুনিক ঢাকা গড়তে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও তা মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ঢাকার সদ্য দায়িত্ব নেয়া দুই মেয়র। বর্তমানে চলমান কার্যক্রমের পাশাপাশি ঢাকাকে উন্নত করে গড়ে তুলতে আরো নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়ারও আশ্বাস দেন ঢাকার দুই সিটির মেয়র। তা ছাড়া নির্বাচনী ইশতেহারে ঐতিহ্যের ঢাকা পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাঁচটি রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন মেয়র তাপস। পাঁচটি রূপরেখা হলো-ঐতিহ্যের ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, সচল ঢাকা, সুশাসিত ঢাকা ও উন্নত ঢাকা। ৩০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।
[৭]অন্যদিকে সুস্থ, সচল ও আধুনিক ঢাকা গড়ার লক্ষ্যে ত্রিমুখী ইশতেহার দেন আতিক। ‘সবাই মিলে সবার ঢাকা’ স্লোগান সামনে রেখে ইশতেহারে বছরব্যাপী মশা নিধন, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নারীর জন্য নিরাপদ নগরী, দখল ও দূষণমুক্ত নগরী, আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা, নিরাপদ সড়ক, ছিন্নমূল পুনর্বাসন, অ্যাপভিত্তিক নাগরিক সমস্যা সমাধান, অনলাইনে সেবা ও স্মার্ট সিটি হিসেবে গড়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। এখন এগুলো বাস্তবায়নের পালা তাদের।
[৮]ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কথা নয়, কাজে বিশ্বাসী। মেয়র পদে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে থেকেই এই মহাদুর্যোগের সময়ে আমি নগরবাসীর পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের পাশে থেকে তাদের অনুপ্রেরণা যোগানোর মাধ্যমে এবং ডিএনসিসির সঙ্গে সমন্বয় করে আমি নগরবাসীর জন্য সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। আমি বিশ্বাস করি আমার ক্ষুদ্র চেষ্টা এই অস্থির সময়ে অসংখ্য মানুষের জীবনে সুখবার্তা নিয়ে আসবে। এই দুর্যোগের সময়ে নগরবাসীর জীবনযাপন স্বাভাবিক রাখতে আপনাদের সঙ্গে নিয়ে এই প্রচেষ্টা চলমান থাকবে। তাছাড়া চলমান কার্যক্রমের পাশাপাশি ঢাকাকে উন্নত করে গড়ে তুলতে আরো নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়া হবে। ইতোমধ্যে ডিএনসিসির ১৬টি কাঁচাবাজার উন্মুক্ত স্থানে স্থানান্তর করা হয়েছে যেন ডিএনসিসির আওতাভুক্ত বাসিন্দারা আরো নিরাপদে দৈনন্দিন বাজার সম্পন্ন করতে পারেন। জনসাধারণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে ডিএনসিসি এরই মধ্যে একটি হটলাইন চালু করেছে বলে জানান তিনি।
[৯]ডিএসসিসির নবনির্বাচিত মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘আমি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে যেটা বলেছিলাম, ৯০ দিনের মধ্যে মৌলিক সেবা তথা করোনা মোকাবিলা, মশক নিধন, আবর্জনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, জনস্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট-যানজট সমস্যা সমাধানে কাজ করব। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মৌলিক সেবা নিশ্চিতে কাজ করব।’ তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির কারণে সুফলটা নগরবাসী পাননি। আমি আগেও বলেছি দুর্নীতি রোধ করব। আজও বলছি প্রথম থেকেই ডিএসসিসির দুর্নীতি রোধে কাজ করব। মশক নিধন নিয়ে বিগত সময়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি। মশক নিধনে যেসব দেশ সফল তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নেব। তাছাড়া অন্যান্য দেশের ভালো কাজগুলো নিয়ে কাজের পরিকল্পনা করব। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কাজ করব। আরো বেগবান করব। আমাদের লক্ষ্য থাকবে ঢাকাবাসীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।’
[১০] অপরদিকে প্রায় অর্ধশত অর্জনের দাবি করে সদ্য বিদায়ী ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, ‘কখনো অবহেলা করিনি। নগরবাসীর জন্য যা যা করা দরকার তা-ই করেছি। নাগরিকদের অন্যতম চাহিদাগুলো পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ এবং ‘জল সবুজে ঢাকা’ প্রকল্প অন্যতম। নগরীর সড়কের ওপর ঝুঁকিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বিলবোর্ডগুলো অপসারণ করে সেখানে বিভিন্ন আকারের ৭৩০টি এলইডি বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। পুরো দক্ষিণে এলইডি স্থাপন করা হয়েছে। ৪৩টি আধুনিক গণশৌচাগার, ৪০টি যাত্রীছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ৫৫টি স্বচ্ছ ট্রাফিক পুলিশ বক্সও নির্মাণ এবং যানজট নিরসনে ৪টি ইন্টারসেকশন ও ৩০টি বাস স্টপেজ নির্মাণ করা হয়েছে। আজিমপুর কবরস্থানের উন্নয়নের পাশাপাশি একটি আধুনিক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া আজিমপুর, জুরাইন ও মুরাদপুর কবরস্থানের আধুনিকায়ন করা হয়েছে।’
[১১]নগরবিদদের মতে, কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, জনগণকে দেয়া কথার সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। নগর উন্নয়নের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। জনগণের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত ও উন্নয়নে অ লভিত্তিক পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণ: দায়িত্ব নেয়ার পরই মশা নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে দুই মেয়রকে। বিগত সময়ে ডেঙ্গু ঠেকাতে হিমশিম খেতে হয়েছে দুই সিটির মেয়রকে। শতাধিক মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। শহরের নর্দমা, নালা ও আবর্জনাও পরিষ্কার করা হয়নি, সেগুলো মশার প্রজনন স্থান। নতুন দুই মেয়রের শপথ অনুষ্ঠানে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন মশা যেন ভোট না খেয়ে ফেলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। ফুটপাত দখলমুক্ত: রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ফুটপাত দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট। সেসব দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলছে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী। সিটি কর্পোরেশন রাজস্ব বি ত হয়। এই ফুটপাত দখলমুক্ত করে মানুষের চলাচলের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে দুই মেয়রকে।
[১২]ঘিঞ্জি পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ফেরানোর চ্যালেঞ্জ: ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকা পড়েছে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে। এখানকার বাড়ি ও সড়কগুলো ঘিঞ্জি। অনেক ভবন পুরনো হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। পুরান ঢাকার ঘোড়ার গাড়ি, প ায়েত ব্যবস্থাসহ ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র তাপস। কাজেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা তার জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। পরিচ্ছন্নতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: দুই সিটিতে দৈনিক প্রায় সাত হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য হচ্ছে। এর মধ্যে সনাতন পদ্ধতিতে দুই সিটি কর্পোরেশন ৭০ শতাংশ অপসারণ করছে। আর ৩০ শতাংশ বর্জ্য এখনো অপসারণ করতে পারছে না। এসব বর্জ্য শহরের নদী-নালা, খাল-জলাশয়ে মিশছে। বাড়ছে নানাবিধ রোগব্যাধি। সিটি কর্পোরেশনকে কর দেয়ার পরও ময়লা নেয়া হয় না, উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যথাযথভাবে হয় না-এমন অভিযোগ নগরবাসীর।
[১৩]গৃহকর আদায়ে অব্যবস্থাপনা: সরকারের বরাদ্দের পাশাপাশি গৃহকর সিটি কর্পোরেশনের আয়ের অন্যতম উৎস। গৃহকর আদায়ে রয়েছে অব্যবস্থাপনা। বাড়িওয়ালা কর পরিশোধ করতে গেলেও সঠিকভাবে পারেন না। ঘুষ দিয়ে সেবা নিতে হয়। এতে অনেকে কর না দিয়েই চলছেন। রাজস্ব-বি ত হচ্ছে নগর সংস্থা।
[১৪] যানজট: ঢাকার অন্যতম সমস্যা হচ্ছে যানজট, যা মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট করছে। যানজট নিরসন সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। যানজট নিরসনের দায়িত্ব পুরোপুরি সিটি কর্পোরেশনের না হলেও জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সহযোগী উন্নয়ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে নিরসন করতে হবে।
[১৫] জলজট: জলজট বা জলাবদ্ধতা নগরীর আরেকটি বড় সমস্যা। নগরীর জলাবদ্ধতার কাজ একা সিটি কর্পোরেশনের নয়, ওয়াসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান জড়িত। কিন্তু যেহেতু জলাবদ্ধতা নিয়ে মেয়রকে ভুগতে হয়, তাকেই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হয়। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘দুজনই (আতিকুল-তাপস) নিজ নিজ পেশায় সফল। তবে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব পালনে অনেক কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেগুলো উতরে জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে।’
[১৬]অনেক সংস্থা জড়িত থাকায় সিটি কর্পোরেশন একা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারবে না উল্লেখ করে ড. তোফায়েল বলেন, নিজের ক্ষমতার মধ্যে সিটির দুই মেয়রকে প্রথমে ফুটপাত ও খাল দখলমুক্ত করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা ও হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ে জোর দিতে হবে।
সূত্র-মানবকণ্ঠ
জলাবদ্ধতা দূর করতে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ট্রাফিক জ্যাম কমিয়ে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। জনগণকে স্বস্তি দিতে অনেক কিছুই করতে হবে মেয়রকে। তিনি বলেন, বাড়ির মালিক কর দিলেও ময়লা পরিষ্কার হয় না। বাধ্য হয়ে স্থানীয় ক্ষমতাধরকে টাকা দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করতে হয়। সেটা বন্ধ করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :