ডেস্ক রিপোর্ট : [২] করোনা ভাইরাস মহামারীকে পুঁজি করে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুক্ত করার মিশনে নেমেছে একটি চক্র। তাকে মুক্ত করতে দেশি-বিদেশি লবিংয়ে কাজ না হলে দেশজুড়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।
[৩] আর সন্ত্রাসীদের জড়ো করে দেশ উত্তপ্ত করার এ নীলনকশা বাস্তবায়নে খরচ ও রসদ জোগাবে জামায়াতে ইসলামী। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে গত ১ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় একটি গোপন বৈঠকে অংশ নেন সাঈদীপুত্র শামীম হোসাইন সাঈদী, বিতর্কিত ইসলামি বক্তা তারেক মনোয়ার, শীর্ষ সন্ত্রাসী বিধান বড়ুয়ার সহযোগী রকি বড়ুয়াসহ বেশ কয়েকজন। সরকারের বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার দীর্ঘ তদন্তে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য।
[৪] সরকারের উচ্চমহলে পাঠানো প্রতিবেদনে সংস্থাটি উল্লেখ করে, গত ২৫ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মানবিক কারণে সাময়িক মুক্তি দেয় সরকার। এর পর পরই যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা সাঈদীর মুক্তির জন্য তৎপর হয়ে ওঠে ওই চক্রটি।
[৫] এরই ধারাবাহিকতায় গত ১ এপ্রিল রাউজানের শীর্ষ সন্ত্রাসী বিধান বড়–য়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী রকি বড়–য়ার লোহাগাড়া উপজেলায় চরম্বা ইউনিয়নের বাসায় গোপন বৈঠক হয়। সাঈদীর ছোট ছেলে শামীম হোসাইন সাঈদী ও শীর্ষ প্রতারক রকি ছাড়াও বৈঠকে ছিলেন বিতর্কিত ইসলামি বক্তা তারেক মনোয়ার, স্থানীয় প্রভাবশালী সফিউল আলম শহীদ, ওসমান, মোস্তাক আহম্মেদ, শহীদ, মাওলানা আবদুস সবুর ও শাহাদাত উল্লাহ।
[৬] বৈঠকের পৃষ্ঠপোষকতা করেন এক সংসদ সদস্য এবং একাধিক ইসলামি সংগঠনের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা। গোপন এ বৈঠকে যোগদানকারীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি উন্মোচন করে দেশ ও জাতিকে রক্ষা এবং জামায়াত ঘনিষ্ঠ ওই এমপির বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়ে সুপারিশও করে গোয়েন্দা সংস্থাটি।
[৭] এর পর গত সোমবার ভোররাতে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের একটি বাড়ি থেকে এক নারী ও চার সহযোগীসহ রকি বড়–য়াকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৭। এ সময় বিদেশি মদ, গুলি ও ম্যাগাজিনসহ একটি বিদেশি পিস্তল জব্দ করা হয়। পাশাপাশি উদ্ধার করা হয় বাংলাদেশ ও অন্য একটি দেশের রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী-এমপিসহ দুই দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে রকির অসংখ্য ছবি, তাদের সিল, প্যাড এবং সাঈদীপুত্র শামীম সাঈদী, তারেক মনোয়ার ছাড়াও হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে তার বৈঠকের ছবি ও বিভিন্ন প্রমাণ। র্যাবের অভিযানের সময় ভবনের তিনতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পালানোর সময় নিচে পড়ে দুটি পা-ই ভেঙে ফেলে রকি বড়–য়া। বর্তমানে সে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
[৮] প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, রকি বড়–য়া লোহাগাড়া উপজেলার চরম্বা ইউনিয়ন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। সে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। রকি বড়–য়া রাউজানের শীর্ষ সন্ত্রাসী বিধান বড়–য়া ও তার অনুসারীদের নিয়ে বড় ধরনের সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টিতে তৎপর ছিল। রকি ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারার বিভিন্ন বাড়িতে বিধান বডুয়াসহ অবস্থান করে। ঘন ঘন সে ঠিকানা বদলায়। সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন কৌশলে সখ্য গড়ে তুলে তা ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করত রকি।
[৯] প্রতিবেদনের আরও বলা হয়েছে, রকি বড়–য়া নিজেকে একটি দেশের বিশেষ এক গোয়েন্দা সংস্থার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন এবং সেই দেশের সরকারের উচ্চপদস্থদের সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে বলে প্রচার করে। প্রমাণ হিসেবে সে তার মোবাইল ফোনে থাকা নেতা-মন্ত্রীদের সঙ্গে নিজের ছবি দেখিয়ে থাকে। কখনো কখনো সে ভিনদেশি সংস্থার সঙ্গে লবিংয়ের মাধ্যমে পদোন্নতি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বশে নেওয়ার চেষ্টা করে।
[১০] অনেক নেতাকর্মীকে এমপি-মন্ত্রী, চেয়ারম্যান-মেম্বার বানিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বড় অঙ্কের টাকাও হাতিয়ে নিয়েছে সে। প্রতারক রকি বড়–য়া নিজেকে ধর্মগুরু পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তাদের সঙ্গে তোলা ছবি দেখিয়ে তা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করত।
[১১] ১ এপ্রিলের ওই বৈঠকে সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদী ও তারেক মনোয়ার তাদের পরিকল্পনার কথা রকি বড়–য়া ও তার সহযোগীদের জানিয়ে বলেন, করোনা মহামারীর এ সময়ে দুটি দেশের লবিংয়ে কারাবন্দি সাঈদীকে মুক্ত করা যেতে পারে। বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে একটি দেশের সঙ্গে লবিংয়ের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রকি বড়ুয়াকে অনুরোধ জানানো হয়। লবিংয়ে সাঈদীকে মুক্ত করা না গেলে সশস্ত্র আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেন শামীম সাঈদ। তিনি বলেন, এ জন্য সব ধরনের কৌশল জামায়াতে ইসলামী গ্রহণ করবে। সব ধরনের রসদ দল থেকে সরবরাহ করা হবে। এ সময় রকি বড়ুয়া শামীম সাঈদীকে আশ্বস্ত করে বলে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যেন গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশের সমর্থন না পায় এ জন্য সব ব্যবস্থা সে করবে। তা ছাড়া তার সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসী বিধান বড়–য়া ও তার দল রয়েছে। যে কোনো ধরনের সহিংসতা করা তাদের পক্ষে সম্ভব।
[১২] একপর্যায়ে শামীম সাঈদী বলেন, দুটি দেশ সাঈদীর মুক্তির বিষয়ে লবিং করছে। রকি বড়–য়াও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। একদিকে লবিং চলবে, অন্যদিকে প্রস্তুত থাকতে হবে, সুযোগ বুঝে আপনাদের ইশারা দেওয়া মাত্রই আন্দোলনের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু আমাদের পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে সময়মতো পৌঁছে দেওয়া হবে। সেই রাতে সাঈদী পুত্রসহ অন্যরা রকির বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করেন এবং সকাল ৮টায় সড়কপথে ঢাকায় ফেরেন। এ ছাড়া সাতকানিয়ার একটি বাড়িতে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ এক নেতার সঙ্গেও শামীম সাঈদী ও তারেক মনোয়ার গোপন বৈঠক করেছেন বলেও গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন বলে প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়।
[১৩] এ ব্যাপারে র্যাব ৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল গতকাল বুধবার বলেন, গ্রেপ্তার রকি বড়–য়া বিভিন্ন সময় নিজেকে ধর্মগুরু থেকে শুরু করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দাবি করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। রকি যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুক্ত করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সাতকানিয়ায় গোপন বৈঠক করেছিল। বিশেষ করে জামায়াত নেতার ছেলের সঙ্গে বৈঠক করে সে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছিল। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসীদের মদদদাতা হিসেবেও চিহ্নিত এই রকি বড়–য়া। ১ এপ্রিল রাতের ওই বৈঠকে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদী ও জামায়াত নেতা তারেক মনোয়ারসহ ১০ থেকে ১২ ব্যক্তি ছিলেন। পরদিন সকালে দুটি দামি গাড়িতে করে তারা ঢাকায় ফিরে যান।
[১৪] র্যাব ৭-এর অধিনায়ক আরও বলেন, বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টার পেছনে রকি বড়–য়ার সঙ্গে বেশ কয়েক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে বিষয়টি এখনই প্রকাশ করা যাচ্ছে না। চিকিৎসাধীন রকি বড়–য়া সুস্থ হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
[১৫] অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল সাঈদীপুত্র শামীম হোসাইন সাঈদীর মোবাইল ফোনে একাধিবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেননি তিনি।প্রিয়ডটকম, আমাদের সময়
আপনার মতামত লিখুন :