বাংলাদেশে রেজিস্ট্রার্ড হেল্থ ফিজিসিয়ান রয়েছে ৫৩,০৬৩ জন (তথ্য: স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়,
২০১১)। এর মধ্যে দেশে কর্মরত রয়েছে ৪৩,৫৩৭ জন। উক্ত জনবলের ৩৫% স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ
মন্ত্রনালয়ের অধীনে, ৫৮% প্রাইভেট সেক্টরে ও বাকী ৩% অন্যান্য সেক্টরে কর্মরত রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে লোক সংখ্যা ১৬৫.৬ মিলিয়ন। উক্ত তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৪০০০ লোকের জন্য এক জন হেল্থ ফিজিসিয়ান কর্মরত রয়েছে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারনে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে হেল্থ ফিজিসিয়ানরা ও কর্ম বিরতিতে রয়েছে। এই অংকটি যদি হিসাব করা হয় তাহলে মোট হেল্থ ফিজিসিয়ানের সংখ্যা ৬৫% কমে যায় কোভিড-১৯ মহামারির আতঙ্কে। সে যাই হোক, আশার কথা হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় দ্রুতগতিতে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বিলম্ভ হলে ও প্রধান মন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তটি নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে।
কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোতে ভেন্টিলের্টস ও আইসিইউ-এর গুরুত্ব অপরিহার্য। সারা দেশে যে পরিমান ভেন্টিলের্টস ও আইসিইউ রয়েছে তা কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসার জন্য খুবই অপ্রতুল। অপরদিকে আইসিইউ বিষয়ে এমডি করা হেল্থ ফিজিসিযানের সংখ্যা খুবই কম। কোভিড-১৯ রোগের কারণে নিউমোসাইট্স নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ফুসফুসের সহিত গ্যাস বিনিময় মারাত্বকভাবে ব্যহত হয়। ফলশ্রুতিতে রোগীর রেস্পিরেসন-এ সমস্যার সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় আইসিইউ ও ভেন্টিলের্টস-এর পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকলে কোভিড১৯ রোগীকে বাচাঁনো খুবই কঠিন হয়ে দাড়াঁয়।
রিভিউ আটিকেল অনুযায়ী, ১৬-ই মার্চ, ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ছিল
৩ জন। কোন মৃত্যু ছিল না। অপরদিকে যুক্তরাস্ট্রে উক্ত দিনে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত লোক ও মৃত্যুর সংখ্যা
ছিল ১৬৭৮ ও ৪১ পর্যায়ক্রমে। বিগত প্রায় একমাস ১৫ দিনে বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃতে্যুর সংখ্যা ৮২৩৮
ও ১৭০ জন যথাক্রমে। অপরদিকে যুক্তরাস্ট্রে আক্রান্ত ও মৃতে্যুর সংখ্যা ১,১৩১,৪৯২ ও ৬৫,৮০০ জন যথাক্রমে (০২ মে, ২০২০ পর্যন্ত)। প্রতি মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় ২০,০০০ রোগীর করোনা পরীক্ষা করা হয় যুক্তরাস্ট্রে।
অপরদিকে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিদিন মাত্র ৫,০০০ করোনা রোগীর পরীক্ষা হয় যা খুবই নগন্য এই বিপুল
জনসংখ্যার দেশে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা কম থাকার কারণে যুক্তরাস্ট্রে মৃতে্যুর সংখ্যা অনেক বেশী বাংলাদেশের তুলনায়। বিষয়টি যদি ও পরিবেশগত সুবিধা তথাপি কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ব্যাপক হারে বাড়তেছে- যা বর্তমানে মহামারির রূপ নিয়েছে।
কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস সার্সকোভ-২ চীনের উহান শহরের হোবেই প্রদেশে গত ৩১ শে
ডিসেম্বর,২০১৯ এ সনাক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ৩-ই জানুয়ারি,২০২০ এ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত প্রথম কোভিড১৯ রোগী সনাক্ত করা হয়। বর্তমানে এই ভাইরাসটি বিশ্বের ২১০ টি দেশে ছড়িয়ে গোটা বিশ্বকে আইসিইউ-তে ঠেলে দিয়েছে। কনস্পাইরেসি তত্ত্ব অনুযায়ী কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী ভাইরাস সার্সকোভ-২ ল্যাব এ তৈরী করা হয়। পরবর্তীতে এটি চীনের উহান শহরের ভাইরোলজি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। তারা সঠিকভাবে এটি হ্যান্ডল করতে না পারায় মানুষের মধ্যে স্থানান্তর শুরু হয়ে যায়। অপরদিকে ধারণা করা হচ্ছে যে, ভাইরাসটি নাকি চীনের উহান শহরের ওয়েট মার্কেটের বন্যপ্রাণী হতে প্রথমে মানুষের মধ্যে স্থানান্তর হয়। বিষয়টি যদি সত্যিই হয়, তাহলে ওয়েট মার্কেটে যেখানে বন্য প্রাণী বেচাঁকেনা হয় সেই মার্কেটটি কেন খুলে দেওয়া হলো।
সব কিছুই রহস্যজনক মনে হচ্ছে। বিজ্ঞান যেখানে মানব কল্যাণের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার কথা সেখানে বিজ্ঞান সারা বিশ্বকে আইসিইউ-তে ঢুকিয়ে দিয়ে অভিশাপে পরিনত হয়েছে। অপরদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে ভাইরাসটি মানবসৃষ্ট নয়। কারন এর গঠন প্রাকৃতি এত জটিল যা মানুষ দ্বারা সৃষ্টি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মত বিশ্বে মধ্যম আয়ের দেশ গুলোতে কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব মহামারির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জিডিপি-তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে পোষাক ও কৃষি সেক্টর। বর্তমানে কোভিড-১৯ এর কারণে দুটি সেক্টরের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়া সত্ত্বেও, বর্তমান সরকারের দক্ষ নেতৃত্ব প্রশংসার দাবি রাখে।
উল্লেখযোগ্য ও দৃষ্টান্তকারী সিদ্ধান্তগুলোর মধ্য একটি হলো সীমিত আকারে কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য বিধি মেনে
গার্মেন্টস খোলা রাখা অতিরিক্ত কোন লোকবল গ্রাম হতে স্থানান্তর ছাড়া। অন্যটি হলো উল্লেখযোগ্য পরিমান
শ্রমিক স্বাস্থ্য বিধি মেনে প্রশাসনের সহায়তায় ধান কাটার জন্য এক এলাকা হতে অন্য এলাকায় স্থানান্তর। আশা করা যাচ্ছে যে, এই দুটি সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে যদি কোভিড-১৯ রোগের স্বাস্থ্য বিধি- অনুসরন করাহয় বাস্তবক্ষেত্রে।
যেহেতু কোভিড-১৯ রোগটি কোন প্রকার লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই এক মানুষ হতে অন্য মানুষে স্থানান্তর হতে পারে সেই জন্য বাংলাদেশের মত সারা বিশ্বের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলোতে প্রায় ৪ মিলিয়ন লোক কাজ করে। যাদের ৯০% এর বেশী লোক স্বাস্থ্যবিধি ও কোভিড-১৯ বিষয়টির গুরুত্ব উপেক্ষা করে দৈনিক আয়-রোজগারের উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এমতাবস্থায় রোগটি দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে গোটা বাংলাদেশ মহামারির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সাধারণ লোকের মধ্যে সচেতনতা থাকা সত্ত্বেও অনেকটা গুরুত্ব কম দিয়ে মাস্ক ছাড়াই রাস্তা ঘাটে বেসামাল চলাফেরা করছে।
অন্যদিকে হেল্থ ফিজিসিয়ানদের পিপিই নিম্নমানের হওয়ায় তাদের মধ্যে অনেকেই কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। আবার আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে নার্স, ওয়ার্ডবয় ও ক্লিনার-ও যাচ্ছে। তাদের জন্য ও হেল্থ ফিজিসিয়ানদের মত পিপিই এর ব্যবস্থা কম দেখা যাচ্ছে। পরিশেষে ধারনা করা যায় যে, আমরা একটি মহামারির মধ্যে জীবন যাপন করছি। এমতাবস্তায় আমাদের করণীয় কি হতে পারে। এই বিষয়টির দিকে নজর দেওয়া অতীব জরুরি। আমরা বাংলাদেশে একদিনে জাতীয় নির্বাচন করে সরকার গঠন করতে পারি। সেটির সহিত যদি তুলনা করা যায়, তাহলে আমাদের উচিত এক মাসের একটি পরিকল্পনা করা। এই পরিকল্পনার আওতায় কোভিড-১৯ মোকাবেলা করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো থাকতে পারে১।
বাংলাদেশে জরুরি ভিত্তিতে কমিউনিটি, উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে কোভিড ও নন্-কোভিড দুটি
ইউনিট করা উচিত।
২। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ৫ জন বিশিষ্ট একটি গ্রুপ করে প্রতিটি গ্রামের/মহল্লার স্কুল গুলোতে ৭ দিন
ব্যপী পরীক্ষা (র্যাপিড টেস্ট কিট/আরটি-পিসিআর) করে কোভিড ও নন্-কোভিড মানুষকে সনাক্তকরণ
নিশ্চিত করত: আক্রান্ত ব্যক্তিদের জরুরী ভিত্তিতে হোম আইসোলেশন অথবা হাসপাতালগুলোর কোভিড
ইউনিট-এ স্থানান্তর করা।
৩। যেহেতুহাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও ভেন্টিলের্টস এর স্বল্পতা রয়েছে, সেহেতু অক্সিজেনের সরবরাহ
সিলিন্ডারের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যা কোভিড রোগীকে শ্বাসকষ্ট হতে রক্ষা করার জন্য ব্যবহৃত হবে।
৪। বেশী আক্রান্ত এলাকায় লক ডাউন দেরিতে খোলা যা সেনাবাহিনীর আওতায় থাকতে পারে।
৫। আক্রান্ত রোগীর জন্য প্যারাসিটামল, প্রয়োজনে এন্টিবায়োটিক ট্যাবলেট ও এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ট্যাবলেটের সরবরাহ রাখতে হবে (হেল্থ ফিজিসিয়ানের উপদেশ অনুযায়ী)।
৬। আইসোলেশন-এ থাকা অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি শারীরিক ব্যায়াম, গরম পানি লবনসহ গড়গড়া, আদা-লবঙ্গ ও কালিজিরাসহ লাল চা পান করতে পারে।
৭। কোভিড এ আক্রান্ত ব্যক্তি সূর্য্যরে আলো হতে ভিটামিন-ডি গ্রহণ ও প্রচুর পরিমানে প্রোটিন জাতীয় খাবার
খেতে পারে যা আক্তান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।
৮। অন্যান্য সচেতনতা যেমন মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব ও হাতধোয়ার বিষয়গুলো অব্যাহত রাখবে কোভিড এ
আক্রান্ত ব্যক্তিরা।
৯। সমগ্র বাংলাদেশে দৈনিক রোজগারের উপর নির্ভরশীল জনগনের তালিকা তৈরী করে তাদের জীবিকার জন্য স্বল্পকালীন বাজেট ঘোষণা করা যেতে পারে। এর ফলে দৈনিক রোজগারের উপর নির্ভরশীল লোকগুলো ঘর হতে বাহিরে যাবে না।
এই বিশ্বকে মহামারির হাত হতে রক্ষা করার জন্য ভেক্সিন ও অন্যান্য চিকিৎসা আসার পূর্ব পর্যন্ত আমাদেরকে
উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে নজরে আনা উচিত।‘‘ভয় নয় সচেতনতাই আসল হাতিয়ার হবে’’ এইকোভিড-১৯ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য। আশা করা যাচ্ছে যে, মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ কোভিড-১৯ মোকাবেলা করার জন্য সচেতন হবে।
লেখক সহযোগী অধ্যাপক, এনভাইরনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ^বিদ্যালয় গাজীপুর
আপনার মতামত লিখুন :