মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী : আল্লাহ মানুষকে অসংখ্য অগণিত নিয়ামত দান করেছেন। প্রতিটি মানুষই আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের মাধ্যমেই চলাফেরা করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দেখা এবং শুনার শক্তি দিয়েছেন, অথচ অনেক লোক এই মূল্যবান নিয়ামত থেকে বঞ্চিত।
এই নিয়ামতগুলোর মূল্য বুঝতে হলে যারা এ নিয়ামত থেকে বঞ্চিত তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি, সুস্থতা, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির মতো মহামূল্যবান নিয়ামতসমূহ দ্বারা আমাদের ভূষিত করেছেন। বরং বলতে গেলে পুরো জগতের যা কিছু আছে যথা চন্দ্র সূর্য, আসমান-জমিন এবং সমস্ত সৃষ্টি আমাদের জন্য কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা আল্লাহর নিয়ামত গণনা করে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয়ই মানুষ অকৃতজ্ঞ ও নাফরমান।’-(সূরা ইবরাহিম, আয়াত ৩৪)।
শাইখুল ইসলাম হজরত আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানি রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, ‘আল্লাহ পাকের নিয়ামত এত অসংখ্য অগনিত যে, যদি তোমরা সবাই মিলে ভাসাভাসাভাবেও গণনা শুরু করো তাহলেও ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বসে পড়বে। আয়াতের শেষ অংশের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অকৃতজ্ঞ ও জালেম ঐ ব্যক্তি, যে এত অসংখ্য নিয়ামত দেখেও নিজের প্রকৃত ও মহান দাতার হক সম্পর্কে সচেতন হয়নি।
আমরা যদি গভীরভাবে আল্লাহর দেয়া নিয়ামতসমূহ নিয়ে চিন্তা করি তাহলে জানা যাবে যে, ঈমানের পর আল্লাহর দেয়া সুস্থতাই বিরাট নিয়ামত। এ নিয়ামত থেকে বেপরওয়া হওয়া মুসলমানের শান হতে পারে না। বিভিন্ন হাদিস দ্বারা জানা যায় যে, সুস্থতা আল্লাহর আমানত। তাই আমানত রক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ব্যক্তিগত লাভ ছাড়াও এটা তার দ্বীনী দায়িত্ব। সুস্থতা পেয়ে বেপরওয়া হওয়া আমানত খেয়ানতের নামান্তর।
সুস্থতার ব্যাপারে হাজারো দার্শনিক, ডাক্তার, বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা আছে। কিন্তু আমাদের জন্য মূলনীতি আমাদের নবীজি সা. দিয়ে গেছেন। নবীর দেয়া নির্দেশনাগুলো মেনে আমরা ভালোভাবে সুস্থ-সবল থাকতে পারি। অনেক রকমের অসুস্থতা থেকেও বাঁচতে পারি। যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব নবীজি সা. এর এই বাণী দ্বারা স্পষ্ট হয়- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক। অর্থাৎ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছাড়া মুমিনের ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। সুস্থতা রক্ষার মূলনীতিতে শারীরিক পরিচ্ছন্নতা, মন-মানস পবিত্রতা, আশপাশ পরিচ্ছন্নতা, স্বভাব-অভ্যাসের পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার এবং সমময়মতো চিকিৎসা সবই এতে অন্তর্ভুক্ত। সুস্থতার গুরুত্ব দেওয়া এবং তা রক্ষা একজন মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।
ছোট ছোট উইপোকা যেভাবে বড় বড় কুতুবখানা ধ্বংস করে দিতে পারে, ঠিক সুস্থতার ব্যাপারে সাধারণ অবহেলা এবং ছোট অসুস্থতায় বেপরওয়ার কারণে মারাত্মক এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে। সুস্থতার ব্যাপারে অবহেলা এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় ত্রæটি আল্লাহ তায়ালার অকৃতজ্ঞতাও বটে।
একজন বড় মাপের চিন্তাবিদ সুস্থতার ব্যাপারে লিখেছেন, মানুষের জীবনের মূল ধাতু হলো জ্ঞান-বুদ্ধি, চরিত্র, ঈমান এবং অনুভূতি। জ্ঞান-বুদ্ধি, চরিত্র, ঈমান এবং অনুভূতির সুস্থতার ভিত্তি অনেকাংশেই শারীরিক সুস্থতা। জ্ঞান-বুদ্ধি, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা, উত্তম চরিত্রের ফজিলতের দাবি এবং দ্বীনী দায়িত্ব আদায় করার জন্য শারীরিক সুস্থতার বিকল্প নেই।
মানুষ খুব দ্রæতই অতীতের কথা ভুলে যায়। পবিত্র কুরআনেও এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে, মানুষকে যখন বিপদ স্পর্শ করে তখন শুয়ে-বসে-দাঁড়ানো অবস্থায় আমাকে ডাকতে থাকে। আর যখন তাকে বিপদ মুক্ত করে দেই তখন এমনভাবে চলে যায় যেন সে বিপদে পড়ে আমাকে ডাকেইনি।’-(সূরা ইউনুস, আয়াত ১২)।
দুটি অবহেলিত নিয়ামত: হজরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, সারওয়ায়ে কায়েনাত (সা.) ইরশাদ করেছেন, দুটি নিয়ামত রয়েছে যেগুলি সম্পর্কে অধিকাংশ লোক ধোঁকাগ্রস্ত হয়ে আছে। সুস্থতা এবং অপরটি অবসর’-(সহিহ বুখারি, হাদিস ৬৪২২)।
অধিকাংশ লোক ধোঁকাগ্রস্ত থাকার অর্থ হলো, প্রথমত এই দুই নিয়ামত সাধারণত একসাথে লাভ হয় না। অনেক মানুষ সুস্থ, কিন্তু তার অবসর নেই। আবার অনেকে অবসর, কিন্তু সুস্থ নয়। আর কারও ভাগ্যে যদি উভয় নিয়ামতই জুটে যায় তবে এর প্রকৃত মূল্যায়ন খুব কম লোকই করে থাকে; বরং অযথা কাজকর্মে এ দুই নিয়ামত নষ্ট হয়ে যায়।
সুস্থতার জন্য দোয়া: হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম সা. ইরশাদ করেন, আজান ও ইকামতের মাঝামাঝি সময়ে দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আমরা কিসের দোয়া করবো? নবীজি সা. ইরশাদ করেন, তোমরা দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, ও সুস্থতার জন্য দোয়া করবে।’-(সুনানে তিরমিজি, হাদিস ৩৫৯৪)।
এবার নবীজির চাচা হজরত আব্বাস রা.-এর প্রতি নবীজির উপদেশবাণী লক্ষ করুন, তিনি ইরশাদ করেন, ‘হে আব্বাস! হে আল্লাহর রাসূলের চাচা! আপনি আল্লাহ তায়ালার নিকট দুনিয়া-আখেরাতের শাস্তি, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও সুস্থতা প্রার্থনা করুন।’-(সুনানে তিরমিজি, হাদিস ৩৫১৪)।
হজরত ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. সর্বদা সকাল-বিকাল পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকাল আফিয়াতা ওয়াল ফিদ-দুনয়া ওয়াল আখিরাতি’ অর্থ: ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার নিকট দুনিয়া ও আখেরাতের সুস্থতা ও কল্যাণ প্রার্থনা করি।’-(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৫০৭৪)।
লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, ৪৩ নবাব সলিমুল্লাহ রোড, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ সদর, নারায়ণগঞ্জ।
আপনার মতামত লিখুন :