ফয়জুল্লাহ আমান : পবিত্র মাহে রমজানুল মুবারক আসন্ন। নবীজী রমজানের দু’মাস আগে থেকেই সাহাবীদের প্রস্তুত করতেন এ মহান মাহিনার জন্য।
সহি হাদীসে এসেছে রাসূল সা. রজব মাসের চাঁদ দেখেই এ দোয়া করতেন, হে আল্লাহ তুমি আমাদের বরকত দাও রজবে ও শাবানে এবং পৌঁছে দাও রমজানে। [মুসনাদু আহমাদ]
এবার শাবান মাস শেষ হয়ে এল প্রায়। এখনও আমাদের ভেতর কোনো প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। করোনা কী আমাদের সব ভুলিয়ে দিয়েছে?
শত দুর্যোগের ভেতরও আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা মুসলিম। মুসলিম কখনও ঘাবড়ে যায় না। নিজের দায়িত্বের কথা ভুলে যায় না। বিস্মৃত হয় না পরকাল ও ধর্মের কোনো বিষয়।
দুর্যোগকবলিত মানুষ আরও বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে মনোযোগী হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের জীবনে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা। আমরা যেন আমাদের জীবনের লক্ষ্যগুলো ভুলে বসে আছি। হয়ত আমাদের সময় কাটছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, নয় তো চরম আলস্য ও উদাসীনতায়। আল্লাহ হেফাজত করুন।
আসুন আমরা রমজানের প্রস্তুতি শুরু করি। রমজানুল মুবারককে স্বাগত জানাতে মানসিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করি। পবিত্র কুরআনে রমজান শব্দটি একবারই এসেছে। সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে।
আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘রমজান এমন এক মহিমান্বিত মাস যে মাসে নাজিল করা হয়েছে পবিত্র কুরআন, যে মহাগ্রন্থে রয়েছে মানবজাতির জন্য পথনির্দেশ, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং যে গ্রন্থ সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে রোজা রাখে।’ [সূরা বাকারা]
পবিত্র কুরআনের এ আহ্বান আমাদের সামনে আলোকবর্তীকা হয়ে আছে। আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে পবিত্র মাসটির কথা। আসুন, রমজানের আমলগুলো এই এখনই পরস্পরে আলোচনা করে নেয়া যাক।
রমজানের প্রধান আমল দুইটি। রোজা ও তারাবি। সারা দিন পানাহার ত্যাগ করে থাকা। বড় কষ্টের আবার মধুরও। রোজার মাসে না খেয়ে থাকায় যে আনন্দ, সারা বছর মজার মজার খাবার খেয়েও হয়ত সে আনন্দ নেই। সারা দিনের রোজা রাখার পর আবার প্রভুর দরবারে দীর্ঘ নামাজে দাঁড়িয়ে থাকা।
এ নামাজকে বলা হয় তারাবির নামাজ। দীর্ঘ সময় নিয়ে এ নামাজ আদায় করা হতো। প্রতি চার রাকাত পর পর এ জন্য বিশ্রামের সময় দেয়া হতো।
তারাবি অর্থ বিশ্রাম। যে নামাজের মাঝে বারবার বিশ্রামের সময় দেয়া হয় তাকেই তারাবির নামাজ বলে। এ রমজানে আমাদের হয়ত অফুরন্ত সময় থাকবে। প্রথম যুগের মুসলিমদের মতো খুব স্থিরভাবে তারাবি আদায়ের চিন্তা করতে পারি আমরা।
জুমা বা জামাতে মসজিদে যেতে পারছি না আমরা। খুব দ্রুতই যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে তা মনে হচ্ছে না। এ অবস্থা বাকি থাকলে রমজানের তারাবির নামাজও হয়ত মসজিদে অনুষ্ঠিত হতে পারবে না। তাই বলে কী আমরা তারাবি পড়ব না?
অবশ্যই আমাদের তারাবি পড়তে হবে। আমাদের দেশে অসংখ্য হাফেজ রয়েছেন। প্রত্যেকেই আমরা চেষ্টা করব একজন হাফেজের পিছনে খতমে তারাবি পড়তে। ঘরে ঘরে জুমার নামাজ বৈধ কী না সে বিষয়ে আলেমদের বিভিন্ন মত থাকলেও প্রতিটি ঘরে যে খতমে তারাবি বৈধ সে বিষয়ে কোনোই মতানৈক্য নেই।
প্রত্যেক ঘরে না হোক প্রতিটি বিল্ডিংয়ের কোনো একটি অংশে আমরা পারি খতম তারাবির আয়োজন করতে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রির ব্যবস্থা রেখে আমরা সুন্দরভাবে আয়োজন করতে পারি এবারের তারাবির সালাত।
রোজার মাসে রোজা ও তারাবির পর গুরুত্বপূর্ণ কাজ কুরআন তেলাওয়াত। যাদের কুরআন তেলাওয়াত শুদ্ধ নেই তারা আর দেরি না করে এ রমজানের ভেতরই কুরআন শুদ্ধ করে নিতে পারেন। পাশাপাশি পড়তে পারেন কুরআনের তর্জমা ও তাফসীর।
আল্লাহর কালাম বুঝে পড়ার আনন্দই আলাদা। কুরআনে বিশ্ব মানবতার জন্য রয়েছে হেদায়াত ও প্রশান্তি। চতুর্থ আমল দান সদকা। রমজানে একটি নফল অন্য সময়ের ফরজের সমান সওয়াবের।
একটি ফরজ অন্য সময়ের সত্তরটি ফরজের সমান। যাদের ওপর যাকাত ফরজ তারা রমজানে যাকাত আদায় করলে বহু গুণ বেশি সওয়াব পাবেন। বর্তমান যে দুর্যোগ শুরু হয়েছে এ সময় বেশি বেশি সদকা করা অতীব জরুরি।
যাকাতের ক্ষেত্রে মাসআলা হচ্ছে- বিশেষ দুর্যোগের সময় কয়েক বছরের যাকাত একসঙ্গে আদায় করা যায়। বিত্তশালীরা এবার রমজানে আগামী কয়েক বছরের যাকাত একবারে আদায় করতে পারেন। আপনি আমি হয়ত কেবল রমজানে না খেয়ে থাকি। অনেকে আছে যারা রোজা না রেখেও উপস থাকতে হয়। চরম দারিদ্র্য আর অভাবের কারণে।
আমাদের না খেয়ে থাকার বিধানের একটি কারণ এও যেন আমরা উপস থাকা মানুষগুলোর কষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। সহমর্মী হতে পারি দুস্থ অসহায় মানুষের প্রতি।
রমজান মাস রহমতের মাস। মাগফিরাতের মাস। নাজাতের মাস। ইবাদতের বসন্ত কাল হচ্ছে মাহে রমজান। মুমিনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার এ মাহিনা। সেহরি, ইফতারি, তারাবি তেলাওয়াত ও দান-সদকার মাধ্যমে অনন্য এক উৎসবময় ক্ষণ হয়ে উঠে রমজান।
এবারে আমরা পেতে যাচ্ছি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রমজান। কতটা দুর্যোগ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আমরা জানি না। শুধু জানি অবস্থা যতই খারাপ হোক আমরা মুসলিম। আমাদের সবর করতে হবে।
যে কোনো পরিস্থিতিতেই আমাদের অটল থাকতে হবে ইমানের পথে। বেশি বেশি প্রার্থনা করতে হবে বিপদ থেকে বাঁচতে। আর সতর্ক-সচেতন হয়ে চলতে হবে প্রাত্যহিক জীবনে।
আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা করেই আমাদের পার করতে হবে কঠিন সময়গুলো। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, ধৈর্যধারণকারীদের অপরিমিত পুরস্কার দেয়া হবে। [সূরা যুমার, আয়াত: ১০]
রোজার ফজিলত সংবলিত একটি হাদীস দিয়েই রমজানের প্রস্তুতির কথা শেষ করব। রাসূল সা. ইরশাদ করেন, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, প্রতিটি আমল দশ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। রোজা ব্যতীত অন্য সব আমলের জন্য এই হিসাব। আর রোজা কেবল আমার জন্যই। আমি নিজ হাতে এর প্রতিদান দিব।
রোজাদার আমার জন্যই পানাহার ও মনের চাহিদা ত্যাগ করেছে। রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। একটি আনন্দ ইফতারের সময়, আরেক আনন্দ যখন সে তার রবের সাক্ষাৎ লাভ করবে। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিশকাম্বারের চেয়ে অধিক প্রিয়। [বুখারী, মুসলিম]
সূত্র : যুগান্তর
আপনার মতামত লিখুন :