প্রথমআলো : মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ও তাঁর স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস পরিচালিত দাতব্য প্রতিষ্ঠান বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারি রোধে ও একটি কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরিতে অর্থায়ন করছে। এরই মধ্যে সাড়ে ৪ হাজার কোটি ডলারের বেশি অর্থায়ন করেছে তাঁদের ফাউন্ডেশন। মেলিন্ডা ও বিল গেটস অনেক আগে থেকেই এ ধরনের মহামারির আশঙ্কা প্রকাশ করে এটি প্রতিরোধে বৈশ্বিক প্রস্তুতির ডাক দিয়েছিলেন।
গত ৯ এপ্রিল মেলিন্ডা গেটসের মুখোমুখি হয়েছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার। আলাপে এমন মহামারি ভবিষ্যতে আরও দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেন মেলিন্ডা গেটস। বিজনেস ইনসাইডারের প্রধান সম্পাদক এলিসন শনটেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা, এর ভ্যাকসিন তৈরিতে চলমান গবেষণাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন মেলিন্ডা গেটস।
এর কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
এলিসন শনটেল: সম্প্রতি মার্কিন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউচি বলেছেন, ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যাবে না। সবার জন্য একটি ভ্যাকসিন পেতে কত সময় লাগবে বলে আপনি মনে করেন?
মেলিন্ডা গেটস: আমার মনে হয় ১৮ মাসের মতো সময় লাগবে। বহু বছর ধরে ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা করছেন এমন অনেকের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। তাঁদের দেওয়া তথ্য আমাদের এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। কারণ, প্রথমে আপনাকে সংশ্লিষ্ট যৌগগুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তারপর প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায় পেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ ট্রায়ালের ধাপ। আমি নিশ্চিত যে ভ্যাকসিনের পরীক্ষার জন্য এফডিএ (মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি দ্রুততর করবে, যেমনটা তারা করেছিল ইবোলার সময়। তারপরও কার্যকর ও নিরাপদ পরীক্ষার জন্য সময় লাগবে। এরপর রয়েছে ভ্যাকসিনটির উৎপাদনের পর্যায়। মনে হয় সত্যি ১৮ মাসই লাগবে। সুসংবাদ হচ্ছে, ভ্যাকসিন তৈরির কাজে অনেক বিজ্ঞানী এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা এগিয়ে আসছেন, বলছেন, আমার এই প্ল্যাটফর্মটি সবাই ব্যবহার করতে পারি। ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো যৌথ উদ্যোগ নিচ্ছে এবং বলছে, ভ্যাকসিন হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে একযোগে এর উৎপাদন শুরুর জন্য আমরা কী প্রস্তুতি নেব? এমন অনেক ভালো বিষয় এখন ঘটছে। কিন্তু এটি এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে শর্টকাটের সুযোগ নেই। কারণ, আপনি কখনোই একজন মানুষের শরীরে ক্ষতিকর কোনো কিছু প্রবেশ করাতে চাইবেন না।
এলিসন শনটেল: ঠিক। আপনি কোনো মানুষের শরীরে এমন কোনো ভ্যাকসিন দিতে চাইবেন না, যা করোনাভাইরাস থেকে তাকে মুক্ত করলেও তাকে অন্যভাবে অসুস্থ করে তুলবে। নিরাপত্তার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মেলিন্ডা গেটস: আমি এও যোগ করতে চাই যে প্রয়োগের আগে আমাদের জানতে হবে ভ্যাকসিনটি কাকে কী মাত্রায় দিতে হবে। আমরা জানি যে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, অ্যাজমার মতো স্বাস্থ্যগত সমস্যা রয়েছে, এমন ব্যক্তিদের কোভিড-১৯-এ ঝুঁকি বেশি। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টির দিকে তাকাতে হবে। এমন কোনো ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে না, যা কোনো ব্যক্তির হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করবে। তাই অনেক কিছু পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
এলিসন শনটেল: এমনকি হতে পারে যে ১৮ মাস পরও আমরা কোনো ভ্যাকসিনের দেখা পেলাম না?
মেলিন্ডা গেটস: হতে পারে। গত পাঁচ বছরে আমাদের বিজ্ঞান কতটা এগিয়েছে, তার দিকে তাকাতে হবে। আমাদের হাতে কী কী যৌগ আছে, সেটি বিবেচনা করতে হবে। শুধু আমাদের অংশীদারদের হাতেই রয়েছে ১৪ হাজারের মতো যৌগ। এর বাইরে আরও অনেক যৌগ নিয়ে বর্তমানে পরীক্ষা চলছে। এটা কি আশাব্যঞ্জক? এগুলোর মধ্যে কোনো একটিতে কি আশার আলো আছে? এই যৌগগুলোকে পরীক্ষা করতে করতে আমরা যাচ্ছি। আমি সত্যিই মনে করি যে একটি ভ্যাকসিনের দেখা আমরা পাব। ইবোলার ভ্যাকসিন আমরা পেয়েছ্,ি তাই না? আর এতে আমরা এটি ১৮ মাসের মধ্যেই তৈরি করেছিলাম। এটা কঠিন ছিল। যখন আমি দেখি যে বিশ্বের নানা প্রান্তে থাকা বিজ্ঞানীরা একজোট হচ্ছেন, তথ্য ও উপাত্ত বিনিময় করছেন, তখন আমি আশাবাদী যে আমরা একটি ভ্যাকসিন পাব।
এলিসন শনটেল: এটা জেনে খুব ভালো লাগল।
মেলিন্ডা গেটস: আরও অনেক কাজ চলছে। চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি এমন ওষুধ খুঁজে বের করতে, যাতে কোভিড-১৯ আক্রান্তের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো যায় বা রোগটির প্রভাব কমিয়ে আনা যায়। আশা করি আমরা এমন কিছু ওষুধ খুঁজে পাব, যা এই রোগে আক্রান্তদের এতটা অসুস্থ করবে না, যাতে তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে থাকতে হয়, যা খুবই বেদনাদায়ক।
এলিসন শনটেল: হার্ড ইমিউনিটির ধারণা নিয়ে কিছু বলবেন? আমরা কি এটি অর্জন করতে পারব নাকি এটি অনেক দূরবর্তী ভাবনা?
মেলিন্ডা গেটস: এটি এখনো অনেক দূরবর্তী ভাবনা। মোট জনসংখ্যার একটি বিপুল অংশ আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত এমন কিছু অর্জন সম্ভব নয়। অতীতে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এমন বিভিন্ন রোগের ইতিহাস থেকেই আমরা এটি জানি। ভাইরাসটির বিরুদ্ধে গণপরিসরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হতে অনেক দূর যেতে হবে। এ জন্য আমাদের অপেক্ষা করাও উচিত নয়। কারণ, তাতে অনেক লোক মারা পড়বে। অনেক মৃত্যুর বিনিময়ে আমরা হয়তো হার্ড ইমিউনিটির দেখা পাব। এ কারণে এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে থাকা উপায়—সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার মতো বিষয়ে মানুষকে সচেতন করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যা কিছু কার্যকর বলে জানি, তা নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
এলিসন শনটেল: ভ্যাকসিন পাওয়ার পর গণপরিসরে তা বিতরণের সর্বোত্তম পন্থা কী হতে পারে? কাদের আগে পাওয়া উচিত?
মেলিন্ডা গেটস: দরিদ্র, উন্নয়নশীল বা ধনী দেশ যে দেশেই থাকুক না কেন, একজন ব্যক্তি যাতে ভ্যাকসিনটি কিনতে পারে, সেদিকে লক্ষ রেখে এর দাম যেন কম হয়, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। এটি করা সম্ভব। ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের মাধ্যমে আমরা এটি আগেও করেছি। ১৯৯০ সাল থেকেই এই সংস্থা কাজ করছে। তাই আমরা জানি, এটি কীভাবে করতে হবে। ভ্যাকসিনের সরবরাহের কাজটি আমাদের সতর্কভাবে করতে হবে। প্রথমেই দিতে হবে স্বাস্থ্যকর্মীদের। তাদের নিরাপদ রাখতে পারলেই, তারা অন্যদের নিরাপদে থাকতে সহায়তা করতে পারবে। তারপর সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের কাছে এটি পৌঁছাতে হবে। তারপর এটি সমাজের সর্বস্তরে সমানভাবে বিতরণ করতে হবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোভিড-১৯ আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিদ্যমান সব অসাম্যকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। এ কারণে আমাদের এটি দেখতে হবে যে ম্যাসাচুসেটস যখন ভ্যাকসিনটি পাচ্ছে, তখন ক্যালিফোর্নিয়া বা নিউইয়র্ক বাদ পড়ছে না তো? বর্তমানে ৫০টি অঙ্গরাজ্য মাস্ক, পিপিই ইত্যাদির জন্য একটি আরেকটির সঙ্গে যেভাবে লড়ছে, সেভাবে এটি করা যাবে না। এর কোনো অর্থ হয় না। এ জন্য জাতীয় একটি কৌশল প্রয়োজন, যাতে ভ্যাকসিনটি সমানভাবে সবখানে পৌঁছানো যায়। সবার আগে অবশ্যই সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের কাছে এটি পৌঁছাতে হবে।
এলিসন শনটেল: গত জানুয়ারিতে অ্যানুয়েল ট্রাস্ট ব্যারোমিটার প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, সংবাদমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা কম। সরকারের ওপর আস্থা আরও কম। কিন্তু গুরুতর সামাজিক সমস্যার সমাধানে মানুষের আস্থা ক্রমেই ব্যবসায়ী নেতাদের ওপর বাড়ছে। বিল গেটস ও আপনি নিজেদের ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দারুণ সব কাজ করছেন। এই সংকটে মার্ক জাকারবার্গ বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন। শেরিল স্যান্ডবার্গও একইভাবে অবদান রাখছেন। জেফ বেজোস ও জ্যাক ডোরসিসহ অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। কথা হচ্ছে সরকারের বাইরে এটি কি ব্যবসায়ী নেতাদের কাজ? আমরা কি এমন প্রত্যাশা করা উচিত?
মেলিন্ডা গেটস: আমি দেখছি যে মানুষ এগিয়ে আসছে। ফাউন্ডেশনে আমরা প্রতিদিন বহু ই-মেইল পাচ্ছি। এসব ই-মেইল শুধু আমার বা বিলের (গেটস) কাছেই আসছে না, আমাদের বিজ্ঞানীদের কাছেও আসছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা এগিয়ে এসেছেন। অনেক সমাজসেবী এগিয়ে এসেছেন। অনেকেই এগিয়ে আসছেন তথ্য ও জ্ঞান নিয়ে। নানা তথ্য দিয়ে তাঁরা বলছেন, ‘এ বিষয়ে কি আমাদের মনোযোগ দেওয়া দরকার? আমাদের কী করা উচিত?’ আপনার প্রশ্ন ছিল, এটি কি ব্যবসায়ীদের কাজ? এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। শুধু ব্যবসা খাতের সমাধান করতে পারবে না। শুধু ব্যবসায়ী ও সমাজসেবীরাই এর সমাধান করতে পারবে না। সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। সবার যত্ন নেওয়ার প্রয়াসে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিপুল অর্থায়নের কাজটি করে সরকার। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজসেবী, ব্যবসায়ী ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর একযোগেই সাড়া দিতে হবে। সবচেয়ে দারুণ যে বিষয়টি লক্ষ করছি, তা হলো, ড. ফাউচির মতো মানুষ এগিয়ে এসে সবাইকে সঠিক তথ্যটি দেওয়ার কাজ করছেন। এই মানুষদের কথাই এখন আমাদের শোনা উচিত। এমন বহু লোক এগিয়ে এসেছেন, যাঁরা পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। একদিকে ঝুঁকিপূর্ণদের নিয়ে চিন্তা যখন রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে, তখন সকালে সঠিক কাজটি কে চলা অগণিত মানুষ আমাকে সাহস জোগাচ্ছে।
এলিসন শনটেল: এটি কি স্প্যানিশ ফ্লুর মতো শতবর্ষে একবার আসা কোনো মহামারির মতো? এমন আরও মহামারির জন্য কি আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে?
মেলিন্ডা গেটস: এটি শত বছরে একবার আসা কোনো মহামারি নয়। এমন আরও পরিস্থিতির মুখে আমাদের নিশ্চিতভাবেই পড়তে হবে। কোভিড-১৯—এটি ভয়াবহ রকমের সংক্রামক। কিন্তু এটি হামের মতো ছোঁয়াচে নয়। আমরা হাম নিয়ে কাজ করেছি। আমরা জানি কীভাবে কাজ করতে হয়। এমন আরও মহামারির মুখে আমরা পড়ব। সে জন্য আমাদের পরিকল্পনা থাকতে হবে।
এলিসন শনটেল: কেন এমন মনে হচ্ছে?
মেলিন্ডা গেটস: অনেক কারণেই এমনটা হবে। সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমরা একটি বৈশ্বিক সম্প্রদায়। আমরা ভ্রমণ করি এবং সেই সূত্রে রোগ ছড়িয়ে দিই।
আপনার মতামত লিখুন :