সাবিক আহমেদ নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় :[২] পাট বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যময় আশ উৎপাদনকারী অর্থকরী ফসল। বর্তমানে দেশে ৮ লাখ হেক্টরের ওপরে পাট ও পাটজাতীয় ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ২০০৯ সালকে “আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক তন্তু বর্ষ” হিসেবে পালিত হওয়ায় এবং উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়কারী কৃত্রিমতন্তুর জনপ্রিয়তা বা ব্যবহার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। পাট খাতে নতুন স্বপ্ন, নতুন যুগের সূচনা হয় বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোবারক আহমদ খানের। পাট থেকে তৈরি তাঁর পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগের উদ্ভাবনের মাধ্যমে।
[৩] সোনালি ব্যাগ: সোনালি ব্যাগ হলো পাট থেকে উদ্ভাবিত এক ধরণের পলিথিন ব্যাগ। পাট থেকে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনের এই প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করেছেন বাংলাদশি বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান। সোনালি ব্যাগ উদ্ভাবনের পর ২০১৭ সালের ১২ মে লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে পণ্যটির পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। পাটের সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব ২০০০ পিস পলিব্যাগ উৎপাদন শুরু করে কারখানাটি। পাটজাত এ পলিথিন ব্যাগের নাম ‘সোনালি ব্যাগ’ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
[৪] সোনালিব্যাগ তৈরির পদ্ধতি: গঠনগত দিক থেকে পাট জটিল পলিমারের সমন্বয়ে গঠিত, যাতে প্রধানত সেলুলোজ ৭৫ ভাগ, হেমিসেলুলোজ ১৫ ভাগ এবং লিগনিন ১২ ভাগ রয়েছে। এছাড়া স্বল্প পরিমাণে ফ্যাট, মোম, নাইট্রোজেনাস ম্যাটার, বিটাক্যারোটিন ও জ্যানথোফেলাস থাকায় পাটপণ্য পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব। ২০১৭ সালে পাট ও পাটজাত বাজারে সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব। সোনালিব্যাগ উদ্ভাবন করেন পরমাণু শক্তি কমিশনের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান। পাটকলে ফেলে দেয়া পাটের আঁশ থেকে প্রথমে সূক্ষ্ম সেলুলোজ আহরণ (এট্রাকশন) করে আলাদা করে নেয়া হয়। পানিতে অদ্রবণীয় এই সেলুলোজগুলোকে পরে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে পরিবর্তন (মডিফিকেশন) করা হয়। দ্রবণীয় সেলুলোজের সাথে ক্রসলিঙ্কার মেশানো হয়। বিশেষ তাপমাত্রায় রাসায়নিক বিক্রিয়ায় দ্রবণটি ড্রয়ার মেশিনের ভেতরে পরিচালিত হয়। তাতে তা শুকিয়ে প্লাস্টিকের শিটের আকারে যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসে। পরে শিট কেটে চাহিদামতো পলিব্যাগের আকার দেয়া হয়। এক কেজি পাট দিয়ে এক কেজি পলিথিন উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদিত ব্যাগে ৫০ শতাংশের বেশি সেলুলোজ বিদ্যমান। পানি নিরোধক এই পলিব্যাগের প্রতি কেজির দাম পড়বে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে এ ব্যাগ বাজারজাত করা হলে এর দাম আরও কমবে। সম্পূর্ণরূপে পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব এ ব্যাগ পানিতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত টিকে থাকে তারপর ধীরে ধীরে গলতে শুরু করে, ক্ষতিকর কোনো কেমিক্যাল এতে ব্যবহার না করায় ৫-৬ মাসের মধ্যেই মাটিতে মিশে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। দেখতে বাজারের সাধারণ পলিথিন ব্যাগের মতো হলেও পলিইথিলিন ব্যাগের চেয়ে দেড়গুণ টেকসই ও মজবুত পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ। প্যাকেজিং মেটেরিয়াল বিশেষ করে তৈরি পোশাকের মাোড়ক হিসেবে এবং খাদ্য দ্রব্য সংরক্ষণেও এ ব্যাগ ব্যবহার করা যায়।
[৫] পরিবেশের উপর পলিথিনের প্রভাব: বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি এবং বছরে প্রায় ৫ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এর মাত্র ১ শতাংশ পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং সমুদ্রে ফেলা হয় ১০ শতাংশ। এসব পলিব্যাগ একশ বছরেও পচবে না ও মাটির সঙ্গে মিশবে না, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার মানুষ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক পাখি ও জলজ প্রাণী। বাংলাদেশে ১৯৮২ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিনে উৎপাদন শুরু হয়। পলিথিনের অতি ব্যবহারের কারণে ১৯৯৮ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । ২০০২ সালে দেশে আইন করে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাত ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয় । দামে সস্তা ও অন্য কোনো বিকল্প না থাকায় নানা সরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় নি ।
[৭] পলিথিনের বিকল্প হিসেবে এর গুরুত্ব : পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি পলিব্যাগের কতটা গুরুত্ব তা বোঝা যায় বিশ্বজুড়ে পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পলিথিন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত থেকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭২টি দেশে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। সব দেশেই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে শাস্তির বিধান করলেও ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। কেনিয়া সরকার কারো হাতে পলিথিন দেখলেই গ্রেপ্তার করার বিধান জারি করেছিল। উগান্ডার বিমানবন্দরে পলিথিনসহ কাউকে পেলে তাকে গ্রেপ্তার করার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু পলিথিনের বিকল্প না থাকায় তা বেশি দিন বাস্তবায়ন করা যায়নি। আয়ারল্যান্ডের সরকার পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে বাড়াতি কর আরোপ করেছে। পর্তুগাল, স্পেনও এ ধরনে না পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২০ সাল থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করার আইন করছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।
সোনালি ব্যাগ ক্রয় বিভিন্ন দেশের আগ্রহ: ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সিটি কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ শহরকে পলিথিনমুক্ত রাখতে এই ব্যাগ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং দুবাইয়ে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মাসে ২৫,০০০ পলিব্যাগ কেনার ফরমাশ দিয়েছে। গত বছরের ২ অক্টোবর পাট থেকে সোনালি ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য যুক্তরাজ্যের এক কোম্পানির সঙ্গে বিজেএমসির একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও একটি এনডিএ স্বাক্ষরিত হয়। সম্প্রতি ইতালি, ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশবিনাশী অন্যান্য উপাদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্ত্র ব্যবহারের দিকে। এক্ষেত্রে পাই হয়ে উঠেছে বিকল্প অবলম্বন।
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপঃ পাটনীতি প্রণয়ন পাটকল করপোরেশন সংস্কার এবং পণ্যের ব্যবহার পলিথিনের উপর ইকোট্যাক্স আরোপ করা হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় সার, চিনি, ধান, চালসহ ১৭টি পণ্য । বিক্রয়, বিতরণ ও সরবরাহে বাধ্যতামূলক পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিত কল্পে পণ্যে পাটজাত | মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০ প্রণীত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের মোড়ক হিসেবে ৭৫ শতাংশ পাট আছে এমন উপাদান দিয়ে তৈরি মোড়ক ব্যবহারের বিধান রাখা হয়েছে। পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন-২০১০ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে বার্ষিক পাটের ব্যাগের চাহিদা ৯০,০০০ পিস থেকে বেড়ে ৮৪ কোটি পিসে উন্নীত হবে। বহুমুখী পাটপণ্য তৈরির কাঁচামাল জোগান দিতে পদ্মার পারে ২০০ একর জমির । ওপর ২০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পাট পল্পী প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে দৈনিক ২৫,০০০ পিস সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন। ফলে বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের সোনালি আঁশ খ্যাত পাটের ভবিষ্যৎ।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমানে বছরে ৫০০ বিলিয়ন পচনশীল পলিব্যাগের বৈশ্বিক চাহিদা রয়েছে। । বিশ্বের এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে পাটের সোনলি ব্যাগ উৎপাদন করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকেও উৎসাহিত করতে হবে। সোনালি ব্যাগ দামে সাশ্রয়ী হলে পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে। বর্তমানে আমাদের দেশে যে পরিমাণ পাট উৎপাদিত হয়, তার পুরোটা এ খাতে বিনিয়োগ করলে তা বিশ্ব চাহিদার এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ পূরণ করা সম্ভব। অভ্যন্তরীণভাবে পাট আঁশের ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে পাটের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির পাশাপাশি পতিত জমিও পাট চাষের আওতায় এনে পাট খাতে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি সম্ভব হবে। উন্মোচিত হবে পাট নিয়ে নতুন শিল্প সম্ভাবনার দুয়ার। আর এ পাটের হাত ধরেই চিরতরে বিদায় নিবে পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিন।
আপনার মতামত লিখুন :