ডেস্ক রিপোর্ট : [২] ঠান্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়ায় কোভিড-১৯ বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। তাই অনেকে আশা করছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে করোনা ভাইরাসের বিস্তার কমে যাবে। কিন্তু মৌসুমি রোগের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে যা কাজ করে, মহামারির ক্ষেত্রে অনেক সময় তা প্রযোজ্য হয় না। বিবিসি ফিউচার বিভাগ এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছে।
[৩] অনেক সংক্রমণ রোগের প্রকোপ মৌসুম বা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে কমে যায়। অনেক ইনফ্লুয়েঞ্জা শীতের মৌসুমে দেখা দেয়, যেগুলো গরম শুরু হলে চলে যায়। আবার টাইফয়েডের মতো অনেক রোগের শীর্ষ সময় গ্রীষ্মকাল। এ কারণে অনেকে জানতে চাইছেন, কোভিড-১৯ বা নতুন ধরনের করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও তাই ঘটবে কি না।
[৪] গত বছরের ডিসেম্বর নাগাদ চীনে যখন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, যখন সেখানে শীত চলছিল। তখন অনেকেই আশা করতে শুরু করেছিলেন, গ্রীষ্মকাল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনা ভাইরাসের প্রকোপও কমে যাবে। কিন্তু এখন অনেক বিশেষজ্ঞ এ ধরনের মতামতের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী জানাচ্ছেন। শুধু তাপমাত্রা নয়, মানুষের আচরণ, তাদের মেলামেশা, একটি স্থানে কত মানুষ অবস্থান করছে, এ রকম আরো কিছু বিষয়ের ওপর ভাইরাসে বিস্তার নির্ভর করে।
[৫] ২০০৩ সালে ছড়িয়ে পড়া সার্স ভাইরাস খুব তাড়াতাড়ি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল। ফলে আবহাওয়ার পরিবর্তন সেটার ওপর কতটা প্রভাব ফেলে, সেই তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে কোভিড-১৯ পরিবর্তিত হয় কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মানব শরীরে সংক্রমিত হওয়া অন্য করোনা ভাইরাসগুলোর মধ্যে বেশ কিছু সূত্র রয়েছে। অনেকে আশা করছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমবে।
[৬] ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজেস-এর পক্ষে কেট টেম্পলটনের চালানো একটি গবেষণায় দেখা গেছে ফুসফুসে সংক্রমিত হয়, এমন তিনটি করোনা ভাইরাস বিশেষভাবে শীতকালেই সংক্রমিত হয়েছে। এসব ভাইরাসের ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যেই বিস্তার দেখা গেছে। আরেকটি ভাইরাসের ক্ষেত্রে কিছুটা বিক্ষিপ্ত প্রবণতা দেখা গেছে।
[৭] কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে আগে ধারণা করা হচ্ছিল এটাও হয়তো ঋতুভিত্তিক একটি ভাইরাস। যেভাবে নতুন ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে, তাতে এটা ঠাণ্ডা এবং শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে বলেই ধারণা করা যায়। যদিও উষ্ণ কয়েকটি দেশেও এর বিস্তার দেখা গেছে। বিভিন্ন আবহাওয়ার বিশ্বের ৫০০ স্থান নিয়ে অপ্রকাশিত একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, কোভিড-১৯ বিস্তারের ক্ষেত্রে ভাইরাস ও তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহ এবং আর্দ্রতার সম্পর্ক রয়েছে। আরেকটি অপ্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ তাপমাত্রা কোভিড-১৯ রোগের বিস্তার কমাতে পারে। তবে শুধু তাপমাত্রা এই রোগের বিস্তারের ওপর প্রভাব ফেলে না।
[৮] আরেকটি অপ্রকাশিত গবেষণায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, নাতিশীতোষ্ণ উষ্ণ এবং ঠান্ডা জলবায়ু করোনা ভাইরাসের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বের ক্রান্তীয় অংশ এতে কম আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু এসব গবেষণার ক্ষেত্রে কয়েক ঋতু পর্যবেক্ষণ করে বাস্তব তথ্যের বদলে কম্পিউটার মডেলিংয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে গবেষকদের। সমস্যা হলো, অনেক ক্ষেত্রে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগগুলো অন্যান্য ঋতু ভিত্তিক রোগের মতো আচরণ করে না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, এর আগে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাওয়ায় মহামারি স্প্যানিশ ফ্লু গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করেছিল।
[৯] করোনা ভাইরাসের ওপর আবহাওয়ার প্রভাব আছে কি না, তা জানতে এখন বেশ কয়েকটি গবেষণা চলছে। ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট অব স্টকহোমের ইনফেকশাস ডিজিজ কন্ট্রোলের অধ্যাপক জ্যান আলবার্ট বলেছেন, ‘এখন সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন হলো, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাইরাসটির ওপর তার প্রভাব পড়ে কি না। আমরা নিশ্চিতভাবে সেটা জানি না, কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছে যে, এটা হতে পারে।’
[১০] কেন সেটা আশা করছেন বিজ্ঞানীরা?
করোনা ভাইরাস এমন একটি গোত্রের সদস্য যাদের বলা হয় ‘এনভেলপড ভাইরাস। এর মানে হলো, এই ভাইরাসের চারপাশে প্রোটিনের তৈরি একটা তৈলাক্ত আস্তরণ থাকে, যাকে বলা হয় লিপিড বাইলেয়ার। এ ধরনের অন্য ভাইরাসগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, এরকম আবরণ থাকায় শরীরের বাইরে, মুক্ত পরিবেশে থাকা অবস্থায় উষ্ণ বা উচ্চ তাপমাত্রার আবহাওয়ায় ভাইরাস দুর্বল হয়ে যায়। এ কারণেই তাপমাত্রা যত বাড়ে, মুক্ত পরিবেশে করোনা ভাইরাসের বিস্তার তত কমতে থাকে।
[১১] গবেষণায় দেখা গেছে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস প্লাস্টিকের মতো শক্ত আবরণের ওপর ২১-২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং ৪০ শতাংশ আর্দ্রতায় ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। অন্যান্য তাপমাত্রায় কোভিড-১৯ ঠিক কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে এবং কী ধরনের আচরণ করে, তা নিয়ে এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তবে অন্যান্য করোনা ভাইরাসের ওপর চালানো পরীক্ষা থেকে জানা গেছে, কম তাপমাত্রায়, অর্থাত্ চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মুক্ত পরিবেশে এগুলো ২৮ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। তাই অনেকেই আশা করছেন তাপমাত্রা বাড়লে করোনা ভাইরাসের বিস্তার কম হবে। কম্পিউটার মডেলিংয়েও দেখা গেছে, চরম তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় কোভিড-১৯ কম টিকে থাকতে পারে।
২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের ওপর চালানো একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, ঠান্ডা, শুষ্ক তাপমাত্রায় এটি ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে। যেমন শক্ত আবরণের ওপর ২২ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওই ভাইরাস পাঁচ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে দেখা গেছে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা যত বেড়েছে, মুক্ত পরিবেশে ভাইরাসের আয়ুষ্কাল তত কমেছে।
[১২] স্পেনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল সায়েন্স ইন মাদ্রিদের গবেষক মিগুয়েল আরাজো বলছেন, মানব শরীরের বাইরে ভাইরাসের ক্ষেত্রে জলবায়ু একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যতক্ষণ ভাইরাসমুক্ত আবহাওয়ায় টিকে থাকতে পারবে, ততক্ষণ সেটা অন্যদের সংক্রমিত করতে পারবে এবং মহামারি হয়ে উঠতে পারবে। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী বিস্তার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রধানত ঠান্ডা এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় সেটির বিস্তার বেশি হয়েছে।
[১৩] তিনি বিশ্বাস করেন, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার সঙ্গে যদি আগের করোনা ভাইরাসগুলোর মতো কোভিড-১৯ একই আচরণ করে, তাহলে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের আবহাওয়ার সঙ্গে তাল রেখে তার বিস্তারের পার্থক্য হবে। তবে এ ক্ষেত্রে মানুষের আচরণও অনেক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। —বিবিসি, ইত্তেফাক
আপনার মতামত লিখুন :