বাংলা ট্রিবিউন : [২] দেখতে কিছুটা ইয়াবার মতো। কিন্তু ইয়াবা ট্যাবলেট নয়, ব্যথানাশক ওষুধ। এই ট্যাবলেটই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ইয়াবা আর হেরোইনের বিকল্প হিসেবে। গুঁড়ো করে ইয়াবা আর হেরোইনের মতো সেবন করছে মাদকসেবীরা। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ট্যাপেন্টাডল ও মিথাইল হাইড্রোক্লোরাইড জেনেরিক নামের বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধগুলো দেদারছে বিক্রি হচ্ছে ওষুধের দোকানে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, স্বল্প আয়ের মানুষেরা ইয়াবার বদলে ব্যথানাশক এই ওষুধ মাদক হিসেবে ব্যবহার করছে।
[৩] মঙ্গলবার (১০ মার্চ) তুরাগ এলাকা থেকে বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় এক হাজার ট্যাবলেটসহ রফিকুল ইসলাম ও ইব্রাহিম মিয়া নামে দুই ফার্মেসি ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ওষুধ যথাযথ নজরদারি করে মার্কেট থেকে তুলে না নিলে এটিই নেশা জাতীয় ট্যাবলেট হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে যেতে পারে। এজন্য এখনই কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
[৪] ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি একটি চুরির মামলার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে এই ওষুধ সম্পর্কে জানতে পারি। একটি চোরচক্রের কিশোর বয়সী কয়েকজন সদস্য নিয়মিত এসব ওষুধ খেতো। পরবর্তীতে বিষয়টি অনুসন্ধান করা হলে মাদক হিসেবে এটি ব্যবহারের ব্যাপক তথ্য পাওয়া যায়।’ তিনি বলেন, ‘এটি বন্ধ করতে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা ও ফার্মেসিগুলোতেও তদারকি করা প্রয়োজন।’
[৫] ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ট্যাপেন্টাডল ও মিথাইল হাইড্রোক্লোরাইড জেনেরিক নামের বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ মাদক হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি নজরে আসে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের । এরপর গত ১২ জানুয়ারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় অনকোলজিস্ট, রিউমাটোলজিস্ট, অর্থোপেডিক সার্জন, নিউরোলজিস্ট, মেডিসিন ও সার্জারি বিশেষজ্ঞের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ট্যাপেন্টাডল জেনেরিক জাতীয় বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ বিক্রয় বা সেবন করা যাবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল/ক্লিনিক এবং সরকারি ক্রয় ব্যতিত এই ওষুধ সরবরাহ করা যাবে না। বাজারে সরবরাহ করা এ জাতীয় ওষুধ পাইকারি ও খুচরা ফার্মেসি থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাহারের বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়। এমনকি ট্যাপেন্টাডল ওষুধটিকে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮’-তে ‘খ’ সিডিউলভুক্ত করার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
[৭] তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসিআই ফার্মাসিউিটক্যাল, এসকেএফ, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল, ইনসেপ্টাসহ বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির এসব ওষুধ রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের অনেক ফার্মেসিতেই এখনও বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব ওষুধ সাধারণত সুনির্দিষ্ট রোগীদের জন্য প্রতি ট্যাবলেট সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১০ টাকা হারে বিক্রি করা হতো। কিন্তু মাদকসেবীদের কারণে এসব ওষুধের দাম বেড়ে গেছে। এখন প্রতিটি ট্যাবলেট ৫০ থেকে দেড়শ’ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
[৮] পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত নিম্ন আয়ের লোকজন ইয়াবা ও হেরোইনের বিকল্প হিসেবে এসব ওষুধ সেবন করে থাকে। বিক্রি নিষিদ্ধ করার পরও ফার্মেসি মালিকরা কৌশলে বেশি মুনাফার লোভে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই মাদকসেবীদের কাছে এসব ওষুধ বিক্রি করছে। এ জাতীয় ট্যাবলেট সেবনকারী এক যুবক এই প্রতিবেদককে জানান, এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে তিনি ইয়াবার বিকল্প হিসেবে এই ওষুধের সন্ধান পান। এই ট্যাবলেট গুঁড়ো করে ইয়াবা যেভাবে সেবন করা হয়, সেভাবেই সেবন করতে হয়। এতে ইয়াবার মতোই অনুভূতি হয়। ইয়াবা বা হেরোইনের তুলনায় দাম কম হওয়ার কারণে এটি মাদকসেবীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
[৯] ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরদারির মধ্যে আছে। আমরা ৬৪ জেলা থেকে রিপোর্ট নিয়েছি। ট্যাপেন্টাডল জেনেরিকের ওষুধটি মিসইউজ হচ্ছে। একারণে আমরা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ওষুধটি প্রত্যাহার করে নিতে বলেছি। শুধুমাত্র সরকারি সাপ্লাই এবং হাসপাতাল-ক্লিনিকে এই ওষুধ থাকবে। কোনও ফার্মেসি এই ওষুধ বিক্রি করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
[১০] সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নির্দেশনা অনুযায়ী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু ওষুধ ফার্মেসি থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু অসৎ ফার্মেসি মালিকরা ওষুধ বিক্রি হয়ে গেছে জানিয়ে গোপনে কিছু ওষুধ মুজত করে রেখেছে। সেগুলোই খোলা বাজারে মাদকসেবীদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :