মঈন চিশতী : তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে মোর প্রাণে/সে আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে সব খানে......সুরের অগ্নিবীণা হৃদয়ে বেজে উঠলেই মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর মতো শিক্ষাবিদরাও গেয়ে ওঠে ‘বেশনূ আজ নায় চু হেকায়েত মী কুনাদ/ওয জুদাঈ হা শেকায়েত মী কুনাদ (বাঁশির হাকিকত শোন সে অভিযোগ করছে কেন তাকে তার ঝাড় থেকে আলাদা করা হল?
তাই সে ফুঁ দিলেই কান্না করে, হৃদয়ে বিচ্ছেদের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। শরিয়ত বয়াতিরা গানকে তাদের ইবাদতের অনুষঙ্গ মনে করে। ইবাদতে বাড়াবাড়ি যেমন পরিত্যাজ্য, তেমনি গান, গজল, রাগরাগিনীতেও তা পরিত্যাজ্য তা সবার খেয়াল রাখতে হবে।
গান, গজল, রাগরাগিনী সবকিছুর মূলেই সুরের আগুন। সুরেই জগৎ সৃষ্টি সুরেই বিনাশ। ওয়া নুফিক্বা ফীচ্ছুরে, যখন শিঙায় ফুঁ দেয়া হবে, ফা কানা আফওয়াজা, তোমরা দলে দলে একত্রিত হবে। সুরের আগুন কারও হৃদয় স্পর্শ করুক আর না করুক তা আপন মহিমায় প্রজ্বলিত হচ্ছে। সুরের অপর নাম ছন্দ। ছন্দ আমরা দেখি গীতি-কবিতায়।
পবিত্র কোরআনের ছোট সূরাগুলো কাব্যিক ঢঙে নাজিল হওয়ায় নবীজিকে (সা.) মুশরিকরা কবি বলত। আল্লাহ তাদের চ্যালেঞ্জ করে বলেন লাইসা মিন শায়ের, তিনি কবি নন। কোরআনের কোনো কোনো আয়াতে কবিদের নিন্দা করা হয়েছে; কারণ সমসাময়িক কবিরা তাদের কাব্যগাথায় অশ্লীলতার প্রশ্রয় দিত।
কিন্তু মূলত কবি এবং কবিতা নিষিদ্ধ কোনো বস্তু নয়। আরবের সবাই প্রায় ছিলেন স্বভাব কবি। গান-কবিতা যদি নিষিদ্ধ হতো তাইলে সাইয়েদেনা মাওলা আলীরা বা উম্মুল মুমিনিন মা আয়েশা কাব্যচর্চা করতেন না। গান-কবিতার মূল হল ছন্দ বা মাত্রা। বাতাস তার ছন্দ থামিয়ে দিলে নদী তার চলার ছন্দ থামিয়ে দিলে সাগর তার ঢেউয়ের ছন্দ থামিয়ে দিলে কী হবে একবার ভেবে দেখুন। আমার তো মনে হয় কেয়ামত হয়ে যাবে।
এ সবের ছন্দ বড় একটি সুরের আওয়াজে স্তব্ধ হয়ে যাবে। সেটি ইস্রাফিলের বাঁশির আওয়াজ। আমাদের জীবন এ ছন্দের তালেই চলছে। হার্টের ছন্দ থেমে গেল তো সব শেষ। লাশ হয়ে পড়ে থাকব বালিশ ছাড়া বিছানায়।
কবি বলে ওঠেন ‘একদিন কান্নার রোল উঠবে তব বাড়িতে/আশ পড়শি প্রতিবেশী আসবে সারি সারিতে’। সুর আল্লাহর নেয়ামত দাউদ নবীর মোজেজা। এজন্য দাউদ নবীর বাঁশির সুরে কাঁপত আসমান....কোন কেতাবে লেখা আছে গো হারাম বাজনা গান....মূলত গান হারাম নয়। মদিনায় নবীজিকে শিশু-কিশোররা গান গেয়ে দফ বাজিয়ে স্বাগত জানিয়েছে।
এ গানের কলিতে মদিনা শব্দটি থাকায় নবীজি মদিনার প্রাচীন নাম বদলে মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর করেছেন। গানের পরিপ্রেক্ষিত শব্দ চয়ন উদ্দেশের ওপর এর হালাল-হারাম নির্ভর করে। ইসলাম স্বাভাবিক বা ফিতরাতি ধর্ম। কোনো অস্বাভাবিকতাই ইসলাম অগ্রাহ্য করেনি। শুধু পরিপ্রেক্ষিত উপস্থাপনা বদলে দিয়েছে। গানের মাধ্যমে আমরা আনন্দিত হই, বিনোদিত হই। ইসলামে নির্দোষ বিনোদন শুধু বৈধ নয়, উৎসাহিতও বটে।
মহান শিক্ষক আমাদের নবীজি (সা.) তেমন রাশভারি ছিলেন না। তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত রসিক ব্যক্তিত্ব। কবির ভাষায় ‘একজন প্রেমিক আসিল গো সোনার মদিনায় একজন রসিক আসিল গো সোনার মদিনায়//যার প্রেমরসের গুণে দুনিয়া চমকায়......।
আল কোরআনের ভাষায় তিনি ছিলেন ‘হারিসুন আলাইকুম বিল মু’মিনিনা রাউফুর রাহিম’। তার হাস্যরসের একটি দৃষ্টান্ত, একজন দুস্থ ব্যক্তি নবীজির কাছে এসে বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ আমার কাজ করে খাওয়ার কোনো বাহন নেই। ‘বায়তুলমাল’ থেকে যদি একটি উট দিতেন? নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমি দেখেশুনে তোমাকে একটি উটনীর বাচ্চা দিয়ে দেব’। আগন্তুক বলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি উটনীর বাচ্চা দিয়ে কী করব? আমার তো ভারবাহী উটের দরকার।
নবীজি মুচকি হেসে বলেন ‘ভারবাহী উটও তো কোনো না কোনো উটনীর বাচ্চা’। এ কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে ওঠেন। এমন নিষ্পাপ আনন্দ, ছন্দ, কবিতা, সঙ্গীত ইসলামে কখনও নিষিদ্ধ নয়, ছিলও না। একশ্রেণির অতি পণ্ডিতরা তা নিজেদের স্বার্থে নিষিদ্ধ করে রেখেছেন।
মদিনাতে একজন কবির লক্বব ছিল শাঈরুন্নবী বা নবীজির কবি। তিনি হলেন সাহাবি হাসসান বিন সাবিত। যাকে নবীজি (সা.) মিম্বর বানিয়ে দিয়েছিলেন; সেখানে উঠে নাশিদ বা সঙ্গীত পরিবেশন আর কবিতা আবৃতির জন্য। সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাও কবি ছিলেন, যিনি মুতার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।
শেরে খোদা মাওলায়ে আলী (রা.) কবি ছিলেন। ‘রাদ্বিনা ক্বিসমাতাল জাব্বারে ফীনা লানা ইলমুন ওয়া লিল জুহহালি মালু//ফা ইন্নাল মালা ইয়ুফনি আন ক্বারীব ওয়া ইন্নাল ইলমা বাকীন লা ইয়াজালু (আমরা আমাদের রবের বণ্টনে বড়ই খুশি, তিনি আমাদের তার পরিচয়ের জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছেন, আর জাহেলদের দুনিয়ার মাল দৌলত দিয়েছেন; কেননা অচিরেই পার্থিব সম্পদ ধংস হয়ে যাবে; কিন্তু তার পরিচয়ের জ্ঞান চিরজাগরুক থাকবে) তার এ পঙ্ক্তির দিকে নজর করলেই বোঝা যায় কবিতা কত সাহিত্য ও আধ্যাত্মিক রসে সমৃদ্ধ। মাওলা আলীর কবিতাপঞ্জি ‘দেওয়ানে আলী’।
উম্মুল মুমিনিন মা আয়েশাও কবি ছিলেন। নবীজির প্রশংসায় তার একটি বিখ্যাত দ্বিপদী বা মাসনভী ‘শামসুদ্দুনিয়া তাত্বলাঊ বা’দাল ফাজ্রি//ওয়া শামসী তাত্বলাঊ বা’দাল ঈশাঈ’ (দুনিয়ার সূর্য উদিত হয় ভোর সকালে//আমার সূর্য উদিত হয় এশার রাত্রিকালে) এ কবিতা পড়ে বোঝা যায়, তার কাব্যরসের গুণ আর নবীপ্রেমের ধারা। পরবর্তী সময়ে যারা দেশ-বিদেশে ইসলামের সওদা ফেরি করেছেন প্রায় সবাই তারা কবি-সাহিত্যিক ছিলেন।
সোনারগাঁ পরগনার ইসলাম প্রচারক লালপুরী শাহ রাত নিশিথে জেগে বলতেন ‘পশু পাখি তারা সবে/প্রহরে প্রহরে জাগে, তুই কেন মন মানুষ হয়ে চেতন হইলি না/এমন দয়াল খোদার নামটি লইলিনা। মাওলানা রুমী কৌনিয়ার জঙ্গলে রাত নিশিথে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতেন, ‘আহ্ রা দর আসেমাঁ হামদম নাবুদ/রাজে রা গায়রে খোদা মাহরুম না বুদ’ (রাত নিশিথে আকাশ ছাড়া কেউ দেখেনা/আমার কাঁদার ভেদের কথা খোদা ছাড়া কেউ জানেনা) ছন্দ গীতি কবিতা কারও কারও কাছে ইবাদততুল্য। আর আল্লাহ তো মানুষকে তার ইবাদতের জন্যই সৃষ্ট করেছেন। ওয়ামা খালাক্বতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিয়া’বুদুন। তাই খোদাপ্রেমিক মনীষীরা খোদাপ্রেমের গুণগান ছন্দ কবিতা বা গীতি কবিতায় ব্যক্ত করবে চিরদিন চিরজীবন।
সূত্র : যুগান্তর
আপনার মতামত লিখুন :